দুই দশকে সাত বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির পদত্যাগ
- ইলিয়াস শান্ত
- প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০১:৪৯ PM , আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০২:১৫ PM
দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল ২২ বছরে অন্তত সাত জন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। ভিসি পদের সর্বোচ্চ এই কর্তা ব্যক্তিদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় সরগরম হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসগুলো। অবশেষে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাধ্য হন পদত্যাগে।
২০০০-২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাত জন উপাচার্য বিভিন্ন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেছেন। এদের মধ্যে ঢাবির দুই, জাবির তিন ববির এক এবং বশেমুরবিপ্রবির একজন উপাচার্য রয়েছেন।
গেল দুই দশকে পদত্যাগ করা এসব উপাচার্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী (২০০২), অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ (২০০৯), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন (২০১৩), অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদ (২০০১), অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির (২০১২), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ (২০১৯), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এস এম ইমামুল হক (২০১৯)।
আরও পড়ুন: ভিসি ছাড়া ২০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬টিতে মেয়াদ শেষ
অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
২০০২ সালের ২৩ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের আন্দোলন দমনে পুলিশ ও ছাত্রদল ক্যাডারদের হামলায় প্রায় দুইশ ছাত্রী আহত হয়। পরদিন এ হামলার ‘নির্দেশদাতা’ উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ চলাকালেও পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয় প্রায় পাঁচশ’ শিক্ষার্থী। এছাড়া পাঁচ জন শিক্ষক ও ১০ জন সাংবাদিকও আহত হন।
পরে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ১ আগস্ট পদত্যাগ করেন আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী। সেসময় তার বিরুদ্ধে হামলার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর সেই নিন্দনীয় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে ‘শামসুন্নাহার হল নির্যাতন’ দিবস পালিত হয়। দিনটিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করে।
অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তার পদত্যাগের আগে ঢাবি ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকদিন যাবৎ ছাত্র সহিংসতা বিরাজমান ছিল। সে সময়ে ক্যাম্পাসে চলমান উত্তেজনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে জানা যাচ্ছে।
জসিম উদ্দিন আহমদ
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৭৩-এর অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েসকে সরিয়ে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: অধ্যাপক ফরিদের পদত্যাগ চান না ৩৪ ভিসি
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরাও। পরে শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে অনুষ্ঠিত হয় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। নির্বাচনে হেরে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
শরীফ এনামুল কবির
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব বলয় তৈরির জন্য গণহারে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ ও ছাত্র রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে। এছাড়া ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতেই আরেক ছাত্রলীগ কর্মী জোবায়ের নিহত হন। এসব অভিযোগের দায়ে শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনে দায়িত্ব শেষ হওয়ার ৯ মাস আগেই পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।
মো. আনোয়ার হোসেন
২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল মালেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে মারা যান। হাসপাতালে নেয়ার জন্য সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসায় ও মেডিকেলে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। হামলা ও ভাঙচুরের এই ঘটনায় উপাচার্য আনোয়ার হোসেন দায়ী করেন জামায়াত-শিবিরকে। এমনকি আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও তিনি জামায়াত-শিবির বলে আখ্যা দেন।
এসব ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষক সমিতি। ৯ মাসব্যাপী আন্দোলনে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার এবং দুই দফায় উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ ছাড়া উপাচার্যকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ক্লাস বর্জন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, সিনেট-সিন্ডিকেট ছাড়াও অন্যান্য প্রশাসনিক সভা প্রতিরোধসহ নানা কর্মসূচিতে ভেঙে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এরই জেরে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
ড. এস এম ইমামুল হক
২০১৯ সালের এপ্রিলে টানা আন্দোলনের মুখে বিদায় নিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম ইমামুল হক। অহংকারী স্বভাবের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত এই উপাচার্য তার শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দেয়ায় তার পদত্যাগের দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে অচল হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন: এক মেয়াদের বেশি ভিসি থাকার দরকার নেই: ইউজিসি চেয়ারম্যান
পরে তিনি ওই বছরের ১১ এপ্রিল থেকে তিনি ১৫ দিনের ছুটিতে যান। এরই মধ্যে ২৯ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১১ এপ্রিল থেকে ২৬ মে পর্যন্ত মোট ৪৬ দিনের ছুটি মঞ্জুর করে। উপাচার্য হিসেবে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৭ মে।
ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ
২০১৯ সেপ্টেম্বরে টানা ১২ দিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে সাময়িক বহিষ্কার ও শির্ক্ষীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করায় তার পদত্যাগ চেয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে এক দফা আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্তীদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে উপাচার্য নাসিরের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈতিকস্খলনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এরপর ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর ইউজিসির তদন্ত কমিটি গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখানকার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলার পরই প্রতিবেদন জমা দেয় এই তদন্ত কর্মকর্তাগণ।