চবি ছাত্রীর আত্মহত্যার নেপথ্যে কী— সম্পর্কের টানাপোড়েন নাকি ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা

রোকেয়ার স্বামী কাউছার
রোকেয়ার স্বামী কাউছার  © সংগৃহীত

গলায় ফাঁস দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শামসুন্নাহার হলের এক ছাত্রীর মৃত্যুকে ঘিরে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। রহস্য রয়েছে অনেক কিছু নিয়ে। তবে ওই ছাত্রীর মৃত্যু নিয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন কোন অভিযোগ নেই। গতকাল শনিবার বিকালে হলের দ্বিতীয় তলা থেকে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে প্রথমে ক্যাম্পাসের মেডিকেল সেন্টারে এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

প্রয়াত ওই ছাত্রীর নাম রোকেয়া সুলতানা রুকু (২২)। তিনি চবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে এবং তিনি বিবাহিত বলে তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন।

জানা যায়, রোকেয়ার স্বামীর নাম কাউছার৷ তিনি রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী। ওই ছাত্রীর আত্মহত্যার পেছনে তার দায় থাকতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে নিজ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সম্প্রতি তার সেমিস্টার পরীক্ষা চলছিল। তিনটি পরীক্ষা দিয়েছিলও রোকেয়া। তবে ৪র্থ পরীক্ষার সময় সে অসুস্থ (প্রেগনেন্সি জনিত) হয়ে পড়লে আর পরীক্ষা দিতে পারেনি। এ কারণে হতাশা থেকেও তিনি সুইসাইড করতে পারেন বলে ধারণা অনেকের।

ওই ছাত্রীর পরিচিত চবির শিক্ষার্থীরা জানান, ঘটনার আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্বামী কাউছারের সাথে রোকেয়াকে চবি বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দিকে দেখা গিয়েছিল। এসময় কাউছার রোকেয়ার গায়ে হাত তোলেন বলেও জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

প্রত্যক্ষদর্শী চবি অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাম-পরিচয় গোপন রাখা স্বার্থে বলেন, গত শুক্রবার আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ইফতারের পর ক্যাম্পাসে বেড়াতে বের হই। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা বঙ্গবন্ধু উদ্যানের সমানে দিয়ে যাওয়ার সময় রোকেয়া ও তার স্বামীকে বসে থাকতে দেখি। এসময় দেখি তার স্বামী তাকে শাসাচ্ছেন। তিনি বলছিলেন, তুই ঔষধ খাস না কেন? তুই কি আমারে মারবি? এসব কথা বলে তাকে শাসাতে থাকে।

রোকেয়ার স্বামীর এমন শাসন ও বক্তব্যের পরদিন গতকাল শনিবার শামসুন নাহার হলে ২১০ নম্বর কক্ষে গলায় ওড়না বেঁধে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে চমেক হাসপাতাল তাকে মৃত ঘোষণা করে। 

সেই প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী আরও বলেন, এসময় তিনি রোকেয়াকে থাপ্পড় দিয়ে দিয়ে বলছিলেন, বল, তুই কিভাবে মরবি? গলায় দড়ি দিবি, নাকি অন্যকিছু করবি? কিন্তু, স্বামীর এসব বকাঝকার সময় রোকেয়ার কোনো কথা ছিলনা। সে নিশ্চুপ ছিল। তাকে দেখে হতাশ মনে হয়েছে। পরে আমাদেরকে দেখে তার স্বামী তাকে বলেছিল, চল, ওদিকে চল। এখান থেকে উঠে আয়। ওদিকে চল।

অর্থনীতি বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, বিষয়টিকে আমরা তেমন সিরিয়াসলি নিলাম না। রোকেয়ার মৃত্যুর পর নিউজে তার স্বামী কাউসারের ছবি দেখে চিনতে পারি। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে যারা কথা বলেছিল তারা হলেন রোকেয়া ও তার স্বামী।

রোকেয়ার বান্ধবী সুমনা ইয়াসমিন জানান, রোকেয়া অনেক চাপা স্বভাবের মানুষ ছিল। তার থেকে কথা বের নিতে হতো। সে এমনিতে কিছুই বলতো না। তবে কারো সাথে মিশে গেলে সে সহজভাবেই সব বলে পেলে। 

শিক্ষার্থীদের দাবি, এই ঘটনায় রোকেয়ার স্বামী কাউছারের সম্পৃক্ততা আছে। তাদের দাবি, রোকেয়া পরীক্ষা দিতে পারেনি, তাই হতাশাগ্রস্থ হয়ে সে আত্মহত্যা করেছে বলছেন স্বামী কাউছার। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তার স্বামী তাকে সান্ত্বনা দিতে ক্যাম্পাসে এসেছে। কিন্তু, তারপরও কেন রোকেয়া একাজ করবে? রোকেয়ার মৃত্যুর দিন হলের সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার স্বামী। তিনি কেন হলের সামনে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে ছিলেন? নিশ্চয়ই তিনি আগে থেকে কিছু অনুমান করছেন? তা না হলে তিনি কেন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? 

রোকেয়ার মৃত্যুতে তার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. সাহিদুর রহমান বলেন, আমরা রোকেয়ার মৃত্যুতে খুব দুঃখ পেয়েছি। সে মেধাবী শিক্ষার্থী। সে এবারের সেমিস্টার পরীক্ষায় তিনটি পরীক্ষা দিয়েছিল। ৪র্থ পরীক্ষার সময় সে অসুস্থ হয়ে যায়। সে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তাই পরীক্ষা দিতে পারে নাই। আমাদের বিষয়টি জানালে আমরা তাকে আশ্বস্ত করি সে যেন চিন্তা না করে। তাকে চেয়ারম্যানের নিকট দরখাস্ত করতে বলি। আমরা তার বিশেষ পরীক্ষার নেওয়ার জন্য তাকে আশ্বস্ত করি। এতে সে খুশি হয়ে যায়। 

তিনি আরও বলেন, রোকেয়া প্রেগন্যান্ট ছিল। এ বিষয়টি সে বিভাগের নিকট জানিয়েছেন। আমরা তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছি। সে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হারিসুর রহমান হাওলাদারের সাথে কথা বলছে। তিনিও রোকেয়াকে সান্ত্বনা দিয়েছেন ও বিশেষ পরীক্ষার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন।

চবি প্রক্টর ড. মোহাম্মদ নূরুল আজিম সিকদার বলেন, ওই ছাত্রীর আত্মহত্যার বিষয়ে আমরা ক্যাম্পাসে সিসি টিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করব ও এই বিষয়ে তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবো।

তবে রোকেয়ার বিয়ে এবং প্রেগন্যান্সির বিষয়ে তেমন কিছুই জানতেন না তার পরিবার। রোকেয়ার বড় ভাই আল-আমিন সরকার বলেন, তার বিয়ের খবর আমি মৃত্যুর পরে শুনেছি। তবে, আমার মা বিষয়টা নাকি জানতো। মা-বাবা অসুস্থ থাকার কারণে তাদেরকে এখানে না আসতে বলি। তাই, এই বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারছিনা।


সর্বশেষ সংবাদ