পেশিশক্তি প্রদর্শনের ঘটনা থামছে না ছাত্রলীগে

লোগো
লোগো  © সংগৃহীত

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পেশিশক্তি প্রদর্শনের ঘটনা থামছে না । গত তিন দিনে দেশের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপরাধমূলক কাণ্ড ঘটিয়ে আবারো আলোচনায় সংগঠনটি। দলের নেতাকর্মীদের কেন নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না কিংবা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার শাস্তিই বা কী হচ্ছে? সংগঠনটির নেতারা বার বার বলছেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। বাস্তবে তার প্রতিফলন অবশ্য খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। 

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, ‘‘ছাত্রলীগ একটি বৃহৎ সংগঠন। এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এবারও তাই হচ্ছে। পেশিশক্তি দিয়ে ছাত্র রাজনীতি করার দিন শেষ। এখন বুদ্ধিবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির সময়। আমরা সেই বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’’

‘শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মারধর, ধর্ষনের হুমকি’
পুরানো ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের এক ছাত্রী ছাত্রলীগ নেতার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল ইসলাম আশিকের বিরুদ্ধে।

ওই ছাত্রী বলেন, আমি নিজেও ছাত্রলীগের একজন কর্মী। আশিক বিভিন্ন সময় তার বিশ্বস্ত কয়েক কর্মীর মাধ্যমে আমাকে শারীরিক সম্পর্ক করার প্রস্তাব দেন। তাকে খুশি করলে বড় পদ দেওয়ারও আশ্বাস দেন। কিন্তু আমি তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কর্মীদের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। ক্যাম্পাসে আমার নামে অপবাদ ছড়ান তার কর্মীরা। রাকিব নামে আশিকের এক কর্মী আমাকে নিয়ে অপবাদ ছড়ান।

তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আমি রাকিবকে জিজ্ঞাসা করি,  কেন মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে? ওই সময়ে আশিকের নির্দেশে মারধর ও শ্লীলতাহানি করা হয়। এ সময় আশিক পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে বসলো চমেক প্রশাসন

ওই ছাত্রী বলেন, ‘‘মারধর ও শ্লীলতাহানি করার পর আশিক কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ খান শুভকে ক্যাম্পাসে ডেকে আনেন। এরপর কলেজের ছাত্র সংসদে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন ঘটনার বিষয়টি ভুলে যেতে বলেন। ভুলে না গেলে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেন। এরপর আবারও মারধর করা হয়।’’

এই ঘটনায় ওই ছাত্রী থানায় গিয়েছিলেন মামলা করতে। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির হস্তক্ষেপে পুলিশ মামলা নিয়েছে। তবে মামলার এজাহার থেকে আশিকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। শনিবার ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই ছাত্রী কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। বর্তমানে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে আশিকুল ইসলাম আশিক বলেন, ‘‘ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অভিযোগ আনা হয়েছে। মারধোরের যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে সিসিটিভি আছে। আপনারাও চাইলে সেটা দেখতে পারেন। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মামলা হয়েছে, পুলিশ তদন্ত করুক। আমার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ পায় তাহলে যে ব্যবস্থা নেবে আমি সেটা মেনে নেব।''

ওই ছাত্রীকে চেনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সেও সংগঠন করে। আমার ছোট বোনের মতো।’’

শিবির সন্দেহে চার ছাত্রকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ‘নির্যাতনের’ শিকার হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চার শিক্ষার্থী। এদের দুইজনকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়েছে। এদের একজন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। আরেকজনের অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানা গেছে।

চিকিৎসা নেওয়া দুই ছাত্র হলেন জাহিদ হোসেন ওরফে ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন। অপর দুই ছাত্র হলেন এস এ রায়হান ও মোবাশ্বির হোসেন।

জানা গেছে, বুধবার রাতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ওই চার ছাত্রকে ছাত্রাবাসের নিজ নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যান। পরে তাদের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে তাদের বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়। রায়হান ও মোবাশ্বির বাড়িতে ফিরে যান। জাহিদ ও সাকিব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান।

আরও পড়ুন: চবিতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে নারী সাংবাদিক হেনস্তা

শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী চমেক ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী এ ঘটনায় জড়িত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের মহিবুলপন্থী গ্রুপের নেতা অভিজিৎ দাশ বলেন, ‘‘ওরা শিবির করে। গোপনে এই কাজগুলো করে যাচ্ছিলেন। আমরা তাদের ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন ওরা মোবাইল ফোন লুকিয়ে রেখেছিল।

‘‘পরে ওদের রুমে তল্লাশি করে মোবাইল ফোনগুলো উদ্ধার করা হয়। সেখানে শিবিরের কার্যক্রম সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য আমরা পেয়েছি। সেই তথ্যগুলো ওদের কাছ থেকে রেখে আমরা তাদের ছেড়ে দিয়েছি। এখানে মারধোরের কোন ঘটনা ঘটেনি।’’

মারধর না করলে দুইজনকে হাসপাতালে কেন ভর্তি হতে হলো? জানতে চাইলে অভিজিৎ দাশ বলেন, ‘‘সামনে তো নির্বাচন, ছাত্রলীগকে হেয় করতে এটা তাদের কৌশল। যে দুইজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে, তাদের একজন সেখানে বসে মোবাইল ফোন দেখছিল, কমলা খাচ্ছিল। এমন একটা ভিডিও আমরা সংগ্রহ করার পর ওই ছাত্র পালিয়ে গেছে। আমাদের হাসপাতালে মাত্র ১৬টি আইসিইউ। যেখানে সংকটাপন্ন রোগীরা আইসিইউ পাচ্ছে না, সেখানে এরা কীভাবে অসুস্থ না হয়েও আইসিইউতে ভর্তি হলো সেটা আমাদেরও প্রশ্ন?’’

২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পরে মারামারির পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন মারামারিতে মহিবুলপন্থী মাহাদি জে আকিব নামের এক ছাত্র গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার মাথার খুলির হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এরপর চমেক ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। বারবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

নারী সাংবাদিককে ছাত্রলীগের হেনস্থা, দেখে নেওয়ার হুমকি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হেনস্তার শিকার হয়েছেন ঢাকার জাতীয় দৈনিক সমকালের চবি প্রতিনিধি মারজান আক্তার। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ভিডিও করতে গেলে মারজান আক্তারকে হেনস্তা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে মারজান আক্তারকে উদ্দেশ্য করে নেতাকর্মীরা বলেন ‘তোর নিরাপত্তা কে দেয় তা দেখবো’। পরে চারদিক থেকে ঘিরে তাকে উত্ত্যক্ত করেন তারা। এক পর্যায়ে তিনি সেখান বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদস্য ও চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মারজান আক্তার  বলেন, ‘‘ছাত্রলীগের অনুসারীরা যখন চারুকলার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দিচ্ছিলেন, তখন পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে আমি মোবাইলে ফুটেজ নিচ্ছিলাম। এসময় ছাত্রলীগের ভিএক্স গ্রুপের অনুসারীরা এসে আমাকে আটকায় ও ভিডিও ডিলিট করার জন্য চাপ দিতে থাকে।

আরও পড়ুন: সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রীকে শ্লীলতাহানী ছাত্রলীগ নেতার, করেন মারধরও

‘‘আমি ভিডিও ডিলিট করবো না বলায় তারা আমাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এসময় তারা বলছিলেন, ‘তোর নিরাপত্তা কে দেয় আমরা দেখবো'। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। আমি চলে আসার সময় তারা আমার মোবাইল ফোন ও ব্যাগ কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা করেন।’’

মারজান আক্তার বলেন, ‘‘বিষয়টি জানিয়ে আমি প্রক্টরের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছি। ঘটনার সময় আমি প্রক্টর স্যারকে ফোনও করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার ফোন ধরেননি। এখন মিডিয়ায় বিষয়টি চলে আসায় তিনি তদন্ত কমিটি করেছেন।’’

এ বিষয়ে জানতেই চাইলে প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘‘সাংবাদিকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ পেয়েছি। এমন আচরণের বিষয়ে আমরা এর আগেও ব্যবস্থা নিয়েছি। আজই আমি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছি।

চবি প্রক্টর বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম সোহেলকে প্রধান করে কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন, সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট ড. শিপক কৃষ্ণ দেবনাথ ও সহকারী প্রক্টর ড. আহসানুল কবীর। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কমিটিকে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি।

ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সম্পাদক মারুফ ইসলাম সাংবাদিককে হেনস্থার ঘটনায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে মারুফ ইসলাম বলেন, ‘‘তিনি যখন ভিডিও করছিলেন তখন তার গলায় বা কোথাও পত্রিকার পরিচয়ের কার্ড ছিল না। ফলে কয়েকজন গিয়ে তাকে ভিডিও না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি সেটা না করায় ওই ছেলেদের সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হচ্ছিল। এ সময় আমি গিয়ে তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করেছি। তিনি যখন নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়েছেন তারপর কেউ আর তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। এই ঘটনার পর আমি নিজে তার কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছি।’’

তবে মারজান আক্তার বলেন, ‘‘তিনি যখন দুঃখ প্রকাশ করতে এসেছেন তখনও তার পেছন থেকে একজন আমাকে খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করেছেন।’’

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘‘আমরা সবগুলো ঘটনার ব্যাপারে অবগত। প্রথমত, সোহরাওয়ার্দী কলেজের ঘটনায় আমরাই পুলিশকে বলেছি মামলা নিতে। পাশাপাশি ওই বোনটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে আমাদের কাছে।

ছাত্রলীগ সম্পাদক বলেন, শনিবার রাতেই সভাপতির সঙ্গে বসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ঘটনায় আমি নিজে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। আমাদের সংগঠনে কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান সবসময়ই কঠোর।’’ [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence