বিদেশে উচ্চশিক্ষা: স্বপ্নপূরণে চাই সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

বিদেশে পড়াশোনা করতে চাইলে নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি জেনেই প্রস্তুতি নিতে হবে আগ্রহীদের
বিদেশে পড়াশোনা করতে চাইলে নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি জেনেই প্রস্তুতি নিতে হবে আগ্রহীদের  © সংগৃহীত

বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ। তবে শুধু আকাঙ্ক্ষা থাকলেই হবে না, আকাঙ্ক্ষা পূরণে চাই সুস্পষ্ট পরিকল্পনা। না হলে স্বপ্ন খুব সহজেই হতাশায় রূপ নিতে পারে।
 
পরিকল্পনার শুরুতেই যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তা হলো: উপযুক্ত দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন, যথাযথ প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংরক্ষণ এবং সময়মতো আবেদনপত্র জমা দেওয়া। সঠিক প্রস্তুতি থাকলে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না—তা রূপ নেয় বাস্তবে।

১. প্রথমেই দেশ নির্বাচন

বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই আপনাকে একটি দেশ নির্বাচন করতে হবে। যেখানে আপনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। নিজেকে উচ্চমানে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই। তবে শুধু বিদেশে পড়লেই সেটা হয় না। কারণ সব দেশের শিক্ষার মান ও শিক্ষাব্যবস্থা এক নয়। এই বিষয়টি সবার আগে মাথায় রাখা উচিত। এশীয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি দেশ মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। অনেকে আবার নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, হংকং, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড—এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমান।

২. বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন

বিদেশে কেউ স্নাতক, কেউ স্নাতকোত্তর, কেউবা পিএইচডি করতে যান। আপনি কোন স্তরের শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে ইচ্ছুক সেটা ঠিক করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বয়সের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আপনি কোন বিষয়ে পড়তে যাবেন, সেটা ঠিক করাও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী বিদেশে ডিপ্লোমা, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি যে কোনো লেভেলে পড়তে যেতে পারেন। আপনি চাইলে প্রচলিত সব বিষয়ের বাইরেও নতুন একটি বিষয় নির্বাচন করতে পারবেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাহিদা রয়েছে এমন চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ও নির্বাচন করা যেতে পারে। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসা প্রশাসন, কমার্স, আর্টস, সায়েন্স, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি-ও হতে পারে আপনার উচ্চশিক্ষার বিষয়। দেশ ও বিষয় নির্বাচন হয়ে গেলে আপনাকে সঠিক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ভৌগোলিক অবস্থান, টিউশন ফি, বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আবাসিক সুবিধা, বৃত্তির ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে (Ranking) অবস্থান, পড়াশোনার পদ্ধতি, ভর্তির প্রাথমিক যোগ্যতা, খরচ ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এজন্য আপনি চাইলে গুগল থেকে বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারবেন। 

৩. মূল সনদ সংগ্রহে রাখা

আপনাকে শিক্ষাবোর্ড বা স্কুল-কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল সনদপত্র এবং নম্বরপত্র সংগ্রহ করে রাখতে হবে। স্নাতকোত্তরের জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে স্নাতকের মূল সনদপত্র এবং নম্বরপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ধারিত খামে সনদ পাঠাতে হয়, এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সঙ্গে মূল সনদের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সনদ সত্যায়িত করে রাখতে হবে। 
 
৪. পাসপোর্ট তৈরি রাখা

উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনার সময়ের আগে থেকেই পাসপোর্ট করে রাখা ভালো। কারণ দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবেদনের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট নম্বরের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্নও হতে পারে। এ ছাড়া আইইএলটিএস, টোয়েফল, স্যাট, জিম্যাট, জিআরই পরীক্ষা দিতে পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে পাসপোর্টে নামের বানান অবশ্যই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক সনদের মতোই হতে হবে। কারণ বানানের গরমিলের জন্য অনেকেই ভর্তি বা বৃত্তির আবেদন করতে পারেন না।

৫. ভর্তির শর্ত পূরণ

প্রতিটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভর্তির শর্তাবলি থাকে। আপনি বিষয়ভেদে এবং কোন লেভেলে পড়াশোনা করতে যাবেন, তার ওপর নির্ভর করে শর্তসমূহ। একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই প্রতিটি শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা। যদিও ইউরোপের অনেক দেশে বিষয়টির ক্ষেত্র শিথিলতা রয়েছে। তবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে আইইএলটিএস (IELTS), অনেক দেশে GRE, SAT, GMAT, TOEFL পরীক্ষার মাধ্যমে ভাষাজ্ঞান প্রমাণ করতে হয়।

৬. ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু ও শেষের তারিখ

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে আবেদন করতে ইচ্ছুক, সেখানে কোন তারিখে ভর্তির আবেদন শুরু হয় এবং কবে শেষ হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ও পরিষ্কার জ্ঞান অবশ্যই রাখতে হবে। 

৭. খরচ ও স্কলারশিপ

আপনি যে দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক সে দেশের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে ভালো ও স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। সবাই তো উন্নত জীবনমান ও মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেলে তা লুফে নিতে চায়। তবে সুযোগ লুফে নেওয়ার আগে অবশ্যই লেখাপড়া ও জীবনযাত্রার খরচের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আপনি যদি নিজ খরচে পছন্দের কোর্স সম্পন্ন করতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই কোর্স সম্পন্ন করতে মোট কত খরচ হতে পারে এবং কীভাবে পরিশোধ করতে হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। আপনি চাইলে আপনার পছন্দকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ই-মেইল করে  মোট খরচের একটি খসড়া হিসাব ও পরিশোধের পদ্ধতি জেনে নিতে পারবেন।

যারা স্কলারশিপে পড়তে যেতে ইচ্ছুক তাদের বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে স্কলারশিপের মেয়াদ কতদিন। সেটি নবায়ন করা যাবে কি না। স্কলারশিপ যদি নবায়ন করাও যায়, তবে তা কী ধরনের যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে, তা জানতে হবে। স্কলারশিপের অর্থে কী কী খরচ করা যাবে তা জেনে রাখাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।  

৮. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র দিতে হয়। আপনি সহজেই আপনার পছন্দকৃত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা থেকে এ তথ্য জেনে নিতে পারবেন।  

*জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি);

*পাসপোর্টের কপি (বর্তমান ও আগের পাসপোর্টের ব্যবহৃত পাতা); 

*আবেদন ফরম;

*জন্মনিবন্ধন সনদ;

*সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির অনুমতিসংক্রান্ত চিঠি (কনফারমেশন অব এনরোলমেন্ট);

*স্বাস্থ্যবিমার প্রমাণপত্র;

*শিক্ষাগত যোগ্যতা (সব বোর্ড পরীক্ষার সার্টিফিকেট) ও কর্ম-অভিজ্ঞতা সনদ;

*পূরণকৃত অর্থনৈতিক সামর্থ্যের (স্পনসর বা গ্যারান্টর) ফরম;

*স্পন্সরের সঙ্গে আবেদনকারীর সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে জন্মসনদ, পাসপোর্ট কিংবা স্কুলের কাগজপত্র;

*স্পন্সরের আয়ের উৎসের বিস্তারিত কাগজপত্র;

*সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করে থাকলে সেখানকার কাজের রেকর্ড ও ছাড়পত্র;

*কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (১২ মাসের বেশি পুরোনো নয়);

*বিবাহিতদের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে জন্মসনদ ও বিবাহ সনদ;

*স্বামী-স্ত্রী কেউ মৃত হলে বা স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলে মৃত্যুসনদ বা বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত কাগজপত্র;

*স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রমাণপত্র।


সর্বশেষ সংবাদ