যে কারণে মওলানা ভাসানীর কবর ঢাকায় না হয়ে সন্তোষে হল
- সুজন চন্দ্র দাস, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৮ PM , আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৫ PM
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসেবে সমধিক পরিচিত। ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে তিনি সিরাজগঞ্জে ধানগড়া পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী ও মাতা বেগম শারাফত আলী। তাদের চারটি সন্তানের মধ্যে এক মেয়ে ও তিন ছেলে, তাদের মধ্যে মওলানা ভাসানী ছিলেন সবার ছোট। তার ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। অল্প কিছুকাল স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়া ছাড়া আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি।
তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণ-আন্দোলনের নায়ক। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অন্তিম দিনগুলোতেও তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের সাথে ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে প্রচুর প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন এবং বেশ কিছু সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন, তবে কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেননি। তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তি ছিল কৃষক শ্রমিক জনসাধারণ, যাদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় ‘ভাসানীর মওলানা’ এরপর থেকে তার নামের শেষে ‘ভাসানী’ শব্দ যুক্ত হয়।
১৯৯১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। পরে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করে। মওলানা ভাসানী ১৯২৫ সালে জয়পুরহাটের পাচঁবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তাঁর সহধর্মিণী আলেমা খাতুন কে নিয়ে আসাম গমন করেন। তারপর আসামে প্রথম কৃষক প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মওলানা”এরপর থেকে তার নামের শেষে “ভাসানী” শব্দ যুক্ত হয়।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৩১ সালে সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩ সালে প্রথম কৃষক আন্দোলন সম্মেলন করেন। তারপর ১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অচিরেই দলের আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারত বিভাগের সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আসাম সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এ শর্তে মুক্তি দেয় যে, তিনি আসাম ছেড়ে চলে যাবেন। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পান।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। ভাসানী এর কড়া প্রতিবাদ করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। তিনি এ দলের সভাপতি হন এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানীর। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করেন।
তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর একটি ঘটনা ছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লং-মার্চ।
১৯৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর রাত সাড়ে ৮ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সন্তোষে কবর দেয়া হয়। জানা যায়, তিন নেতার মাজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দোয়েল চত্বরের উত্তর পাশে অবস্থিত (বাংলার তিন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন ও শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক) সেখানে তাকে করব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
সন্তোষ কেন হবে? দুস্থ, হতদরিদ্র এদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। যারা মজলুম, শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষ, জেলে কামার, কুমার, তাতী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার, অধিকার কায়েম করার জন্য এবং দেশ সচেতন করা, রাজনীতি সচেতন করার কঠোর সংগ্রাম করেছেন। আমার কবর যদি ঢাকায় হয়। শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ওদের পাশে হয় রাজনীতিবিদ হিসেবে হতে পারে।
তিন নেতার মাজারে কবর দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মওলানা ভাসানী স্টাডিজ এর কোর্স শিক্ষক সৈয়দ ইরফানুল বারী বলেন, “মওলানা ভাসানীর কবর সন্তোষের সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নেয়নি মওলানা ভাসানী স্বয়ং নিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে যে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটি সন্তোষ মসজিদে হয়। নামাজের পরে সে সময়ের মসজিদের ইমাম এবং আমরা যারা সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম এরকম ৪/৫ জন। তিনি আমাদের সবাইকে মসজিদের পাশে নিয়ে আসলেন আর বললেন তোমরা শুনো, আমার মৃত্যুর পর নানান জনে নানান জায়গায় চাইবে আমার কবর। আমার ইচ্ছে এবং তোমাদেরও করণীয় থাকবে আমার কবর যেন এখানে হয়। সর্বশেষ তিনি থেকে গেছেন যে ছনের ঘরে তার তিন হাত বা চার হাত বাদ দিয়ে সামনে কবর করার অসিয়ত দিয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, সন্তোষ কেন হবে? দুস্থ, হতদরিদ্র এদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। যারা মজলুম, শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষ, জেলে কামার, কুমার, তাতী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার, অধিকার কায়েম করার জন্য এবং দেশ সচেতন করা, রাজনীতি সচেতন করার কঠোর সংগ্রাম করেছেন। আমার কবর যদি ঢাকায় হয়। শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ওদের পাশে হয় রাজনীতিবিদ হিসেবে হতে পারে।
সৈয়দ ইরফানুল বারী বলেন, মওলানা ভাসানী বলতেন, আমি তো শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ ছিলাম না, আমি একজন সমাজ বিপ্লবীও ছিলাম। সারা জীবনের আন্দোলনে সংগ্রাম ছিল আসাম-পূর্ববঙ্গ। সমাজ বিপ্লবী সমাজের সাথে থাকতে চায় রাজধানীতে নয়। রাজধানী হচ্ছে আরাম আয়েশী উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য। আমার অনুগামী, অনুরাগী বা শিষ্য আছে সবাই দরিদ্র। ওরা খরচ করে কোথায় আমার কবর খুঁজবে, কোথায় থাকবে, কোথায় খাবে, কোথায় বসবে, কোথায় রাত্রি যাপন করবে? তাদের ভিতর একটা ভীতি কাজ করবে। হতদরিদ্র মানুষ যেন সহজে দেখতে পারে তাই এখানে দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে মওলানা ভাসানীর নাতি ও ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের সহকারী রেজিস্ট্রার এম. এ. আজাদ সোবহান খান ভাসানী বলেন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সারা পৃথিবীতে তিনি মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের নেতা ছিলেন। ১৯৭৬ সালে ১৭ই নভেম্বর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত আটটা বিশ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর সরকারিভাবে ঢাকায় কোথাও কবরস্থ করার চিন্তাভাবনা ছিল। আমরা যতদূর জেনেছি, ঢাকা যে তিন নেতার মাজার রয়েছে সেখানে কবরস্থ করার কথা ছিল।
আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী এবং পারিবারিকভাবে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হইলে আমার দাদি তখন জীবিত ছিলেন আমার দাদি বলেন, যেহেতু মওলানা ভাসানীর শেষ ইচ্ছে উনাকে যেন সন্তোষে কবরস্থান দেওয়া হয়। কেননা সন্তোষ একটি নিবৃত গ্রাম। উনি সারা জীবন গ্রামে থেকে রাজনীতি করেছেন। ওনার করবটা যেন গ্রামে দেওয়া হয়। যাতে করে খুব সহজেই বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ যেন উনার কবরের সে দোয়া করতে পারেন। তার ফলশ্রুতিতে ১৮ই নভেম্বর ১৯৭৬ সালে সন্তোষে আজকের এই মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখানে উনাকে সমাধিত করা হয়। দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন লোকজন আসেন, উনার ভক্ত, অনুসারী, অনুরাগীরা আসেন কবর জিয়ারত করতে ঠিক তেমনি হাজারো কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ যারা তারা বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ থেকে আসেন কবর জিয়ারত করতে।
উল্লেখ্য, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি টাঙ্গাইলের সন্তোষে অবস্থিত। তাঁর মাজার ও দরবার হল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত। মওলানা ভাসানীর কবরের পাশেই তার সহধর্মিণী বেগম আলেমা খাতুন ভাসানীর কবর। প্রতি বছর মওলানা ভাসানীর জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। তার প্রকাশিত গ্রন্থ `দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)’ ও ‘মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)’। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বিবিসি বাংলার জরিপে নবম স্থানে রয়েছে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম।