মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নারী শিক্ষার্থীকে অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ শিক্ষকের বিরুদ্ধে

গবেষণায় জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো  © সম্পাদিত

নারী শিক্ষার্থীদের অনৈতিক প্রস্তাব, গবেষণায় জালিয়াতি ও অসদুপায় এবং মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’র জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেরিন বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেনের বিরুদ্ধে। 

এসব অভিযোগ জানিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বিচার দাবি করেছেন। এর মধ্যে—গবেষণায় জালিয়াতি, নারী শিক্ষার্থীকে অনৈতিক প্রস্তাব, সহপাঠীর বিরুদ্ধে সহপাঠীকে দাঁড় করিয়ে শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের মতো ঘটনায় শিক্ষার্থীরা তার শিক্ষক হিসেবে থাকার নৈতিক অবস্থানের বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

এর আগে এ বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত হয়েছে। এরপরও আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেবো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবোরিয়ার এডমিরাল আশরাফুল হক, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি।

এর মধ্যে— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ২০২০-২১ সেশনের মেরিন বায়োটেকনোলজির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল চন্দ্র নামের এক শিক্ষার্থীকে আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণাকর্ম অসম্পূর্ণ রাখার অভিযোগ করতে বাধ্য করাতে না পারায় তার বিরুদ্ধে আরেক শিক্ষার্থীকে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও নারী শিক্ষার্থীদের শারীরিক গঠন নিয়ে অশালীন মন্তব্য এবং আর্থিক কাঠামোয় ফেলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের অভিযোগও জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। 

আর অভিযোগকারী শিক্ষার্থীরা জানান— তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা এখন বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। একই সাথে তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন: 'আপনার স্বামী আর্মিতে, আমার স্ত্রীও ডাক্তার— চলেন পরকীয়া করি'

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ইন মেরিন বায়োটেকনোলজির ছাত্র উজ্জ্বল চন্দ্র অভিযোগ করেছেন তার বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার থিসিস সুপারভাইজার মো. মোরশেদুল আলমের বিরুদ্ধে থিসিসের কাজ অসম্পূর্ণ রাখার অভিযোগ করতে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন। উজ্জ্বল তা প্রত্যাখ্যান করায় তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মিথ্যা অভিযোগ আনা হয় এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এমনকি তার বিষয়ে অভিযোগের কোনো লিখিত কাগজ পাননি বলেও জানিয়েছে তিনি।

পরবর্তীতে তৎকালীন প্রক্টর তাকে কয়েকবার দেখা করতে বললে তিনি লিখিত অভিযোগ চেয়েও পাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ চেক করার কথা বললেও এমন কিছু করা হয়নি বলে জানিয়েছেন। উজ্জ্বল জানান—‘আমি আমার সহপাঠীর কাছে এই মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেন যে,  ‘‘নাজির স্যার যা বলবেন, তিনি তাই করবেন।’’ এরপরই তার বিরুদ্ধে সাজানো অভিযোগ তদন্ত বোর্ডে উপস্থাপন করা হয় এবং তাকে বহিষ্কার করা হয়’’—দাবি করেন উজ্জ্বল চন্দ্র।

‘‘অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। আমরা এখন বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি’’অভিযোগকারী শিক্ষার্থী।

উজ্জ্বল বলেন, ‘আমি এখন আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমার থিসিস সুপারভাইজার যথাযথভাবে তার কাজ সম্পন্ন করেছেন, অথচ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন অনৈতিকভাবে থিসিস সুপারভাইজার পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর কমান্ডার সাইফুল ইসলামের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্ট কমিটি’র মাধ্যমে উজ্জ্বল চন্দ্রের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—সে তার সহপাঠীকে পায়ে পাড়া দিয়ে কথা বলেছে, হাত ধরে টানাটানি করেছে ও জোরপূর্বক রুমে আটকে রেখে কথা বলেছে।’

আরও পড়ুন: ‘এখনই সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অর্ডার করতে হবে’— ১৬ জুলাই ইউজিসিকে নির্দেশ দেন নওফেল

‘‘উজ্জ্বল কমিটির কাছে দোষ স্বীকার করে বলেছে যে সে বুঝতে পারেনি মেয়েটি অভিযোগ করবে। তার বিরুদ্ধে তার ক্লাসের শিক্ষার্থীরা সাক্ষী দিয়েছে ও উজ্জ্বলের পক্ষে কেউ স্বাক্ষী দেয় নি’’—জানিয়েছেন তৎকালীন প্রক্টর সাইফুল ইসলাম।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন উজ্জ্বল চন্দ্র। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি এমন কিছু স্বীকার করিনি, করলে আদালতের দ্বারস্থ হতাম না। আমার নামে সেক্স্যুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ এসেছে যে—আমি ৫০ মিনিট ধরে একটা মেয়েকে আটকে রেখেছি। যদি এমনটাই হয়ে থাকে মেয়েটি তৎক্ষণাৎ কোনো চিৎকার করেনি কেন বা তখন কাউকে জানায়নি কেন?

‘‘অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন আমাকে একাধিকবার অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন’’শিক্ষার্থী, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেরিন বায়োটেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি।

উজ্জ্বল চন্দ্র বলেন, ‘ঘটনার সময় যে রুমের কথা বলা হয়েছিলো—সেটি একটি কিচেন রুম, যার দরজা নেই। আর বন্ধুদের সামনেই আমি ওই মেয়ের হাত দেখতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তার হাত স্পর্শও করিনি। আমার বিপক্ষে যারা সাক্ষী দিয়েছে—তারা সবাই নাজির স্যারের স্টুডেন্ট এবং বাকি দুজন অলরেডি মোরশেদ স্যারের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিয়েছে। তাদের কাছে সঠিক সাক্ষ্য কীভাবে আশা করা যায়’ এগুলো কীভাবে সেক্স্যুয়াল হ্যারাসমেন্টের আওতায় পড়ে—এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেনের বিরুদ্ধে থিসিসের কাজ অনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই প্রোগামের শিক্ষার্থী জান্নাতুল সামিয়া, জনিয়া আক্তার ও আরিফুল আমিন। তাদের অভিযোগ— গবেষণাকর্মে না থাকলেও ড. মোহাম্মদ নাজির নিজের নামে শিক্ষার্থীদের গবেষণা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। 

আরও পড়ুন: ছাত্রদল নেতাদের নেতৃত্বে ইউজিসিতে ‘ক্যু’, সচিবকে অপসারণ; ফেরানো হয়েছে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িতদেরও

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাকসুদা আক্তার শেখ সোহাগ এই থিসিসের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে ‘In-vivo Pharmacological Studies of Hypnea Musciformis Found in the Coast of Saint Martin Island in Bangladesh’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেনকে লেখক হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ ড. মোরশেদুল আলম এবং এ গবেষণাকর্মে বাকী শিক্ষার্থীদের কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সামিয়া এই বিষয়টিকে ‘গবেষণাপত্রে অসদুপায় অবলম্বন’ হিসেবে উল্লেখ করে যথাযথ তদন্ত ও সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দাবি করেছেন। 

গবেষণাকর্মে এমন আরেক ভুক্তভোগী ফিরোজা ইসলাম। তবে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে গিয়েছি এবং বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি। এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’ এছাড়াও গবেষণাপত্রটির লেখক মাকসুদা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এর বাইরে আরেক লেখক শেখ সোহাগের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন: প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ৩০ কোটিরও বেশি অর্থ আত্মসাৎ বহিষ্কৃতদের

গবেষণায় অসদুপায় অবলম্বনের বাইরে নারী শিক্ষার্থীদের অনৈতিক প্রস্তাবের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেরিন বায়োটেকনোলজির এ নারী শিক্ষার্থী বিষয়টি নিশ্চিত করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি জানান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন তাকে একাধিকবার অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন। 

এর বাইরে একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল সামিয়া জানান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির ছাত্রছাত্রীদের নিম্নমানের অশোভন কথা বলতেন। শিক্ষার্থীদের শারীরিক গড়ন নিয়ে বুলিং করতেন। শিক্ষার্থীদের ‘ধনী-গরীব’ অবস্থার প্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করতেন।

আরও পড়ুন: ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

সামগ্রিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে কথা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেরিন বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেনের সাথে। তিনি বিষয়গুলো অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টরের কাছে প্রতিবেদকের নামে সরাসরি অভিযোগ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

আর বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে—অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। 

বিষয়টি নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল আশরাফুল হক, এনবিপি, ওএসপি, বিসিজিএম-এর সঙ্গে। তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, তিনি সম্প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর আগে বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত হয়েছে। এরপরও তিনি বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবেন।


সর্বশেষ সংবাদ