পাহাড়সম অভিযোগ সহকর্মীকে মারধরকারী কুবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে
- কুবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৪ PM , আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:০৮ AM
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও বর্তমান সহকারী অধ্যাপক আবু বকর ছিদ্দিককে (মাসুম) বিভাগীয় একাডেমিক সভায় মারধর করেন একই বিভাগের জুনিয়র শিক্ষক আলী মোর্শেদ কাজেম। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী মোর্শেদ কাজেমের বিরুদ্ধে তুলেছেন বিয়ের প্রস্তাব, নম্বর টেম্পারিং ও নারী শিক্ষার্থীদের উত্যক্তকরণসহ পাহাড়সম অভিযোগ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, মোর্শেদ কাজেম মধ্যরাতে নারী শিক্ষার্থীদের উত্যক্ত করতেন। এছাড়া তিনি নম্বর টেম্পারিং, ছাত্রীদের বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নারী শিক্ষকদেরও মারধর চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। তিনি সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে খারাপ আচরণসহ নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো কথাই বলতে রাজি হননি মোর্শেদ কাজেম। তিনি লিখিত অভিযোগ পেলে মন্তব্য করবেন বলে জানান।
বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে বিভাগের নারী শিক্ষার্থীদের উত্যক্তকরণ করেন তিনি। রাত ১২টা হলেই নারী শিক্ষার্থীদের সাথে কুরুচিপূর্ণ আলাপ শুরু করেন তিনি। পছন্দের নারী শিক্ষার্থীকে প্রশ্নপ্রত্র সাপ্লাই, বিয়ের প্রস্তাব, বেশি নম্বর দেওয়া, শিক্ষক বানানোর মতো প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও বিভাগের সাবেক কম্পিউটার অপারেটর মো. ফরিদ উদ্দিন ও অফিস সহকারী মো. জাকির হোসেনকে বেশ কয়েকবার মারধর করার চেষ্টা করেছেন এই শিক্ষক। মারধর করতে তেড়ে গেছেন আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সায়দা তালুকদার রাহীকেও। তবে এসব অভিযোগ নিয়ে ফেসবুকসহ নিজেদের মধ্যে চর্চা হলেও কেউ প্রশাসন বরাবর কোনো লিখিত অভিযোগ করেননি।
এসব ঘটনার সাক্ষী শিক্ষার্থীরা নিজেরাই। তবে এসব বিষয় নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাখে কথা বলতে রাজি হননি অফিস সহকারী জাকির হোসেন ও বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সায়দা তালুকদার রাহী। শিক্ষার্থীরা তাদের মারধর চেষ্টার সাক্ষী হলেও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বলেই তাদের দাবি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রশাসনিক চাপে হয়তো তারা ভুক্তভোগী হয়েও ঘটনা শিকার করতে পারছেন না।
শিক্ষার্থীরা বলেন, তাদের বাজার করিয়ে টাকা না দেওয়া, ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্যের চেয়ে বেশি টাকায় ভাউচার করে বিভাগ থেকে অর্থ আদায়, নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে কোনো ছেলে চলাফেরা করলে নম্বর কমিয়ে দেন তিনি। এক শিক্ষকের সাথে গবেষণা করায় বিভাগের প্রথম ব্যাচের এক শিক্ষার্থীর ফলাফল কমিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এক ক্লাসে পুরো কোর্স সম্পন্ন করার মতো কাজও করেছেন বলে জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে মহিবুল হক নামের এক শিক্ষার্থী জানান, ২০২০ সালের ফ্রেব্রুয়ারির দিকে উনি নিয়মিত আমাকে ক্লাসে পড়া নেওয়ার অজুহাতে পরপর ৪টা ক্লাসে জঘন্যভাবে অপমান করেন। কীভাবে পাস করি, সেটাও উনি দেখে নেবেন বলে আমাকে শাসিয়েছেন। ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২.৩০-এ অনলাইন ক্লাসে যথাসময়ে জয়েন করার পরও বিনা কারণে ক্লাস থেকে ব্লক করে দেন তিনি। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনার্স রেজাল্ট পাবলিসলড হলে উনার কোর্সে ডিপার্টমেন্টের সর্বনিম্ন রেজাল্ট আমার আসে। মাস্টার্সের ১ম এবং ২য় সেমিস্টারেও উনার কোর্সে সর্বনিম্ন রেজাল্ট আমার আসে।
শামীম আহমেদ নামের একজন সাবেক শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ফেসবুক পোস্টে একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করে বলেন, উচ্চশিক্ষিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো মেয়ের প্রতি মায়ের অনুরোধ, নরাধম শিক্ষক বিয়ের পরও রাত ১২টার পর ফোন দিয়ে বিয়ের আশ্বাস দিতে থাকেন ছাত্রীদের। শিক্ষকের আবদারে রাজি না হওয়াতে ফলাফলে ধস! আর মান-সম্মানের ভয়ে মা তার মেয়েকে বলে ‘মা আল্লাহ আল্লাহ করে মাস্টার্স শেষ করো আসো’।
তিনি বলেন, মোর্শেদ কাজেম স্যারের বিরুদ্ধে কর্মচারী ফরিদকে মারধর করা, ম্যাডামকে মারতে তেড়ে যাওয়া, সুন্দরী স্টুডেন্টদের ইনবক্সে বিরক্ত করা, পছন্দের ছাত্রীকে ইনটেনশনালি নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়া, ছাত্র-ছাত্রীদের রাতে বাসায় ডেকে আপ্যায়ন করা, পছন্দের ছাত্রীর সাথে চ্যাট করায় ১ম ব্যাচের এক ছাত্রকে লাস্টের কয়েকটা সেমিস্টারে সি গ্রেড দেওয়া এবং ক্লাসে পড়াতে না পারাসহ নানাবিধ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের সত্যতার বিষয়ে শামীম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। তিনি বলেন, যা বলেছি সবকিছুই সত্যি। আমার কাছে বেশকিছু মেসেজও আছে। মাসুম স্যার ন্যায় বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের এ আন্দোলন চলবে।
মোর্শেদ কাজেমের বিচার দাবিতে ফেসবুকে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি সোচ্চার হচ্ছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। তারা তার বিচারের দাবিতে ইতিমধ্যে অনলাইন কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন। প্রথমদিনের কর্মসূচিতে বিভাগের শিক্ষার্থীদের “জাস্টিস ফর এবিএস মাসুম স্যার” লিখা সম্বলিত ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
এদিকে, মারধর ও বিচারের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি আইন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান আবু বক্কর সিদ্দিক মাসুমকে। তবে শুক্রবার সকালে দেওয়া এক ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেন, “ক্ষমা করে দেওয়ার মানে হলো আপনি কাউকে আরো একটি সুযোগ দিচ্ছেন, নতুন কিছু শুরু করার। হয়তো এই ক্ষমার মধ্যেই লুকিয়ে আছে নবদিগন্তের দ্বার’’।
তিনি আরও লেখেন, ‘‘প্রতিহিংসায় জর্জরিত আর আক্রোশে কলুষিত এই পঞ্চাশ একর ভূমিতে রোপিত হোক শান্তি, ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বীজ। তৈরি হোক সম্ভাবনাময় আগামীর নব-মহিরুহ। আমাদের সকলের আত্মোপলব্ধি করার অন্তর চক্ষু জাগ্রত হোক। ভাল থাকুক আমার প্রিয় আইন বিভাগ। ভাল থাকুক আমার প্রিয় কর্মস্থল।’’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও মারধরের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে শিক্ষক আলী মোর্শেদ কাজেম সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথাই বলতে রাজী হননি। তিনি বলেন, যদি লিখিত কোনো অভিযোগ আসে তখন আমি কথা বলব। আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষককে মারধরের এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এ এফ এম. আবদুল মঈন মীমাংসা করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাকেও পাওয়া যায়নি।