ক্লাস শেষ করেই ঝাল-মুড়ির দোকান নিয়ে বসেন কুবির আব্বাস
- হাছান আল মাহমুদ, কুবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২২, ০৯:১২ PM , আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২২, ০৯:১২ PM
স্বপ্ন ছিল অন্য আট-দশজন শিক্ষার্থীর মতোই লেখাপড়া করে বড় হওয়ার। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের আর্থিক সংকট ও বাবা-মায়ের টানাপোড়নের সংসার। ১৪ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর এ বাঁধা কয়েকগুণ হয়ে সামনে দাঁড়ায়। কখনো নির্মাণ শ্রমিক, কখনোবা দর্জির কাজ করে স্বপ্ন পূরণে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরেন । সম্প্রতি ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু করেছেন তিনি। ক্লাস শেষ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঝাল-মুড়ির দোকান নিয়ে বসে পড়েন তিনি।
বলা হচ্ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আব্বাস উদ্দীনের কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ছোট্ট একটি বাসায় মাকে নিয়ে বসবাস করেন আব্বাস। সম্প্রতি পরিবারের টানাপোড়ন নিয়ে চিন্তার ভাজ পড়ে আব্বাসের কপালে। তখনি মাথায় আসে ক্যাম্পাসের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রির। পড়ালেখার পাশাপাশি ঝালমুড়ি বিক্রি করে নিজের ও সংসার চালাতে হচ্ছে বলে জানান আব্বাস। তার ভাষায়, ক্লাস শেষ হওয়ার পর যতটুকু সময় পাই সেই সময়টাতে বিক্রি করি। বেচা-কেনা শেষ করে বাসায় যেতে প্রায় রাত ১০টা বেজে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে সহজে ঘুম চলে আসে, তবে রাত ৪টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার চেষ্টা করি।
ছোট থেকেই পড়শোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় এত বাঁধা সত্ত্বেও পড়াশোনা থেকে ছিটকে যাননি আব্বাস। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় থেকে চাকরি করে পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। বিভিন্ন সময় দর্জি, রাজমিস্ত্রির সহকারী, ভিডিও ফটোগ্রাফিসহ নানা কাজ করতে হয়েছিল তাকে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট আব্বাস উদ্দিন। ভাই আক্কাস ও বোন ফাতেমার বিয়ে হয়ে গেলে মা শাহানারা বেগমকে নিয়ে একাই পরিবারের ভার মাথায় নিতে হয় তার।
আব্বাস নুরুল উলুম ইদ্রিসিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে জিপিএ ৪.১৭ পেয়ে দাখিল পাশ করেন। পরবর্তীতে কলেজে ভর্তি হয় এবং প্রথমবারের মতো এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়। তবে আব্বাসের ইচ্ছে শক্তি আর একাগ্রতা দমিয়ে রাখতে পারে নি তাকে। এসময় খালাতো বোন জান্নাতের অনুপ্রেরণায় পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন এবং পরবর্তীতে নানুপুর লায়লা কবির ডিগ্রি কলেজ থেকে ৩.৬৭ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল না করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন ছিল স্কুল জীবন থেকে। তবে আর্থিক অনটন ও পরিবারের ভারে ভর্তির কোচিং করার সুযোগ পায়নি আব্বাস। তাই বলে দমে যাননি আব্বাস, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে বই পড়তেন। এইচএসসিতে প্রথমবার ইংরেজিতে কৃতকার্য হতে না পারা আব্বাস ভর্তি পরীক্ষায় সেই ইংরেজিতে ৩০ মার্কের মধ্য ২৫ পেয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়।
আর্থিক অনটনের কারণে কয়েকটি মেধাবৃত্তি পেলেও শর্ত সাপেক্ষ হওয়ায় নিতে পারেনি তিনি। তবে সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রস্তুতির পাশাপাশি বিদেশে পড়তে চান আব্বাস।
তিনি বলেন, ‘‘অর্থনীতিতে পড়লে বিসিএসের পাশাপাশি বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রায় ১৬টি ডিগ্রির সুযোগ রয়েছে। ফ্রি অথবা ৫০% স্কলারশিপের সুযোগ পেলে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য বিদেশে চলে যাব। তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। নিজস্ব সম্পত্তি না থাকায় এখন থেকেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া পরিবারের আয় করার মতোও মানুষ নেই।’’
আব্বাস দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘‘সুনির্দিষ্ট বসার মতো কোথাও জায়গা পাচ্ছি না, যার কারণে যখন যেখানে জায়গা পাই সেখানে বসে দোকান চালিয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে ব্যবসার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিতে সহজ হতো।’’
তার মা শাহানার বেগম ছেলের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে বলেন, ‘‘পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেই আমার ছেলে ঝালমুড়ির দোকান দিয়েছে। ছেলে সারাদিন খাটাখাটি করে যতটুকু উপার্জন করে তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। তাছাড়া ক্যাম্পাসের বাহিরে রোদ-বৃষ্টি ঝড়-ঝাপটায় নানান সমস্যা পোহাতে হয় তার (আব্বাস)। তবে ক্যাম্পাসের ভেতরে হলে আরও নিরাপদ ও সুবিধা হতো বলে মনে করেন তিনি।’’
আব্বাসের ঝালমুড়ি খেতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ভিড় লেগে থাকে শিক্ষার্থীদের। তারা বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এভাবে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে পারে সেটাই কল্পনাতীত। তার জীবন সংগ্রামের অদম্য সাহস আমাদের মুগ্ধ করছে। তার ঝালমুড়ি কেমন হচ্ছে সেটি বিষয় নয়, সে আমাদের ক্যাম্পাসের। আমরা এজন্য এখানে খেতে আসি। এসময় অনেকে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে আব্বাস বসতে দেয়ার দাবি জানান।’’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমরা পূর্ব থেকে অবগত আছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি, তার নাম আমাদের নোটবুকে আছে। এছাড়াও ভবিষ্যৎ সুযোগ পেলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে চাই।’’
সুনির্দিষ্ট স্থানে আব্বাসের দোকানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রিসোর্স সীমিত থাকার কারণে আমরা কোনো কিছু করতে পারছি না। বিষয়টা সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। এ বিষয় নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলব।’’