সাব-ইন্সপেক্টর হতে চাইলে
- এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
- প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৩৭ AM , আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৫৯ AM
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ‘সাব-ইন্সপেক্টর’ (এসআই) পদে প্রতিবছরই বড় সংখ্যক জনবল নিয়োগ হয়। এসআই নিয়োগের বাছাই পরীক্ষা পদ্ধতি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষারপ্রস্তুতি ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে লিখেছেন এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
বাছাই-পদ্ধতি
সাধারণত বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। স্নাতক ডিগ্রিধারীরাই এসআই পদে আবেদনের সুযোগ পান। নিয়োগের বাছাই পরীক্ষা হয় ৪ ধাপে— ১. শারীরিক পরীক্ষা, ২. লিখিত পরীক্ষা (২২৫ নম্বর), ৩. মৌখিক পরীক্ষা (১০০)। আর সব শেষে ৪. স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন (ভিআর)। শেষ ধাপ পর্যন্ত সফলভাবে টপকাতে পারলেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়া যাবে।
শারীরিক যোগ্যতা ও পরীক্ষা
গত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, পুরুষ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে উচ্চতা কমপক্ষে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি এবং বুকের মাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ৩০ ইঞ্চি। আর নারীদের ক্ষেত্রে উচ্চতা কমপক্ষে ৫ ফুট ২ ইঞ্চি।
বয়স ও উচ্চতার সঙ্গে ওজনের ভারসাম্য থাকতে হবে। প্রার্থীকে দৌড়, জাম্পিং ও রোফ ক্লিম্বিংয়ে অংশ নিতে হবে। এই ধাপ উতড়ালেই প্রার্থী লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হবেন। আর প্রার্থীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে।
লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি
লিখিত পরীক্ষা কয়েকটি বিষয়ের ওপর হয়।
ক) ইংরেজি ও বাংলা—রচনা, কম্পোজিশনে ১০০ নম্বর।
খ) সাধারণ জ্ঞান ও পাটিগণিতে ১০০।
গ) মনস্তত্ত্ব ২৫। সব মিলিয়ে ২২৫ নম্বর। লিখিত পরীক্ষা হয় ৩ দিনে।
লিখিত পরীক্ষায় কেমন প্রশ্ন হয়, জানতে চাইলে গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর (প্রবেশনারি) অশোক কুমার সরকার বলেন, ‘বাংলায় ৫০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। সাধারণত একটি রচনায় ১৫ নম্বর, ভাবসম্প্রসারণে ১০, এককথায় প্রকাশে ৫, অর্থসহ বাক্যরচনায় ৫ ও বাংলা অনুবাদে ১৫ নম্বর।
ইংরেজিতেও ৫০ নম্বর। Essay 15 marks, Appropriate preposition 5, Idioms and Pharase 5, Letter/Application 10, Translations 15। বাংলা ও ইংরেজি উভয় বিষয়েই অনুবাদে তুলনামূলক বেশি নম্বর বরাদ্দ, তাই অন্যান্য টপিকের চেয়ে অনুবাদে বাড়তি জোর দিতে হবে। অনুবাদের প্রস্তুতির জন্য মহিউদ্দীনের লেখা বইটা বেশ কাজে দেবে। এ ছাড়া ইংরেজির প্রস্তুতির জন্য পিসি দাশের গ্রামার বইটি পড়া যেতে পারে।
সাধারণ জ্ঞানের জন্য বরাদ্দ ৫০ নম্বর। এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, টীকা ও রচনা লিখতে হয়। এ অংশের প্রস্তুতির জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, পুলিশবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, মুক্তিযুদ্ধ ও তথ্য-প্রযুক্তির বিভিন্ন টপিক জানা থাকতে হবে। বাজারের মানসম্মত গাইড বইয়ের পাশাপাশি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোও নিয়মিত পড়তে হবে।
পাটিগণিতে ৫০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে। এখানে গসাগু ও লসাগু, ভগ্নাংশ, সরলীকরণ, ঐকিক, গড়, অনুপাত ও সমানুপাত, শতকরা ও লাভক্ষতি, সুদকষা, পরিমাপ, ক্ষেত্র ইত্যাদি থেকে সাধারণত প্রশ্ন আসে। গণিতের প্রস্তুতির জন্য সপ্তম, অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্য বই অনুশীলন করলে প্রস্তুতি পাকাপোক্ত হবে।
মনস্তত্ত্ব দক্ষতায় ৫০ নম্বর বরাদ্দ। এ অংশে সাধারণত ভাষা ও সাহিত্য, সাদৃশ্য বিচার, সাংকেতিক বিন্যাস বা পুনর্বিন্যাস, সম্পর্ক ও বিশেষত্ব নির্ণয়, অসম্ভাব্যতা বিচার, বর্ণবিন্যাস ও শব্দ গঠন, গাণিতিক যুক্তি, জ্যামিতির মৌলিক বিষয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সাধারণ জ্ঞান থেকে প্রশ্ন করা হয়। মনস্তত্ত্বের প্রস্তুতির জন্য বাজারের ‘পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ পরীক্ষার গাইড’ বইগুলো অনুশীলন করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ইউটিউব থেকে মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতার বিষয়গুলো অনুশীলন করলে কাজে লাগবে।
মৌখিক পরীক্ষা
লিখিত ও মনস্তত্ত্ব পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীরাই শুধু মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে খুলনা সদর থানার সাব-ইন্সপেক্টর শাহনেওয়াজ বাপ্পী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, সংবিধান ও পুলিশ সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, সংস্থা, জাতিসংঘ সম্পর্কে সাধারণত প্রশ্ন থাকে। ইংরেজিতে দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য অনুবাদও জিজ্ঞেস করা হয়। এ ছাড়া প্রার্থীকে নিজ জেলার খুঁটিনাটি নিয়ে প্রশ্ন করা হতে পারে, যেমন—নিজ জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তাদের কর্মজীবন, দর্শনীয় স্থান (সেখানে কী কী আছে...) ইত্যাদি।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—নিজ জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা সম্পর্কে জানা, যেমন—কোন কোন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, নিজ পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছেন কি না, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ইত্যাদি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যত বেশি জানাশোনা থাকবে, মৌখিকে ভালো করার সম্ভাবনা তত বেশি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা (কিভাবে, কখন দিয়েছিলেন), মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কারাগারে দিনযাপন, স্বাধীন হওয়ার পর দেশে প্রত্যাবর্তন, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠন থেকে ১৫ই আগস্টের কালো অধ্যায় পর্যন্ত সব তথ্য জানতে হবে।’
প্রয়োজনে নোট করে রাখতে পারেন, যাতে মৌখিকের আগের দিনগুলোতে দেখে যেতে পারেন। জাতির পিতার জীবনী জানলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেকটাই জানা হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রার্থী যে বিষয়ে স্নাতক পড়েছেন, সে বিষয়ের বেসিক ও খুঁটিনাটি জানা থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ভিআর
সবশেষে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ভিআর। মৌখিক পরীক্ষায় নির্বাচিত প্রার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন (ভিআর) ফরম পূরণ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত যেসব প্রার্থী স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যোগ্য ও পুলিশ ভেরিফিকেশনে (ভিআর) ঠিকঠাক হবেন, তাঁদেরই সারদায় (রাজশাহী) এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হবে। সফলভাবে মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ‘শিক্ষানবিশ সাব-ইন্সপেক্টর’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়। পরে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি স্থায়ী হয়।
সুযোগ-সুবিধা
পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টরের সুযোগ-সুবিধা কেমন? জানতে চাইলে খুলনা সদর থানার সাব-ইন্সপেক্টর শাহনেওয়াজ বাপ্পী বলেন, পুলিশের এসআই পদটিকে সেকেন্ড ক্লাস গেজেটেড অফিসার হিসেবে ধরা হয়। এসআইকে পুলিশ বাহিনীর মেরুদণ্ড বলা যায়। কারণ তাঁরা তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন।
নির্বাচিত হওয়ার পর এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ চলাকালে মাসিক এক হাজার টাকা ভাতার পাশাপাশি বিনা খরচে খাওয়া, বাসস্থান, ইউনিফর্ম দেওয়া হয়। একজন সাব-ইন্সপেক্টর ‘সরকারি বেতন স্কেল-২০১৫’ অনুযায়ী দশম গ্রেডের বেসিক ১৬০০০ থেকে ৩৮৬৪০ টাকা হারে বেতন পান।
এ ছাড়া বিনা মূল্যে পোশাক, রেশন, ঝুঁকিভাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, মামলা তদন্ত ভাতা মিলিয়ে প্রথম দিকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো মাসিক বেতন পান। এ ছাড়া বছরে পহেলা বৈশাখ, ঈদ কিংবা পূজায় উৎসব ভাতা পান। বেতন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারলে বিদেশে মিশনে যাওয়ারও সুযোগ মিলতে পারে।
জাতিসংঘের ফর্মড পুলিশ ইউনিটের (এফপিইউ) মিশনে গেলে বছরে ১৫-২০ লাখ টাকার মতো ভাতা পাওয়া যায়। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে পদোন্নতি পেয়ে অ্যাডিশনাল এসপি বা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হওয়া যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়