প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি আদায়ে ‘ইনস্টলমেন্ট’ বাড়ছে

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাস ইস্যুতে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সঙ্কট চলছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, ক্ষতিগ্রস্থ শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীও। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আরোপ করা কিছু শর্ত শিথিল করে গাইডলাইন প্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। যেখানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ক্লাস, সেমিস্টার ফাইনাল ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং ভর্তি কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা দেওয়া। জানানো হবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘টিউশন ফি’ আদায়ের পদ্ধতিও।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইউজিসি ‘টিউশন ফি’ আদায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগে নিষেধ করেছে। যা মানবিক দিক থেকে ঠিক হলেও নিয়মের প্রশ্নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, সেমিস্টার ফি পরিশোধ না করে নতুন সেমিস্টার শুরুর করার রেওয়াজ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বভাবত নেই। তাছাড়া সেমিস্টার ফাইনাল (স্প্রিং-২০২০) দিতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সব বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যদি সেই টাকা দিতে না পারে, তখন ইউজিসি’র সিদ্ধান্ত কী হবে?

শুক্রবার সন্ধ্যায় এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা মূলত সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশা করছি। টিউশন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের গাইডলাইন হলো- শিক্ষার্থীরা যতটুকু পারে, তাদের কাছ যেন ততটুকু ফি আদায় করা হয়। কারণ, আজ হোক কাল হোক; তারা টাকা দেবেই। ফি পরিশোধ না করলে তো কোনো শিক্ষার্থীকে সার্টিফিকেট দেয়া হবে না। তাই আমরা চাই, এই মুহুর্তে যেন আমাদের ছাত্রদের ওপর জুলুম করা না হয়।

করোনা পরিস্থিতিতে টিউশন ফি আদায়ের পদ্ধতি জানিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ফি আদায়ের ক্ষেত্রে ইনস্টলমেন্ট বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীরা হয়তো প্রথম ইনস্টলমেন্টে কিছু টাকা দেবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আরেকটা ইনস্টলমেন্ট দেবে। এভাবে হয়তো অনেক শিক্ষার্থী দেবে; আবার যারা দিতে পারবে না, তাদেরকে জোর করা যাবে না। অর্থ্যাৎ শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় ও মানবিক হতে হবে। কারণ, সব শিক্ষার্থীর পরিবার উচ্চবিত্তের নয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এই বিষয়টাই মাথায় রাখতে হবে।

টিউশন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় সদয় না হলে ইউজিসি ব্যবস্থা নেবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতে আমরা অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে কালো তালিকাভুক্ত করেছি। যদিও তারপরও সেখানে ছাত্ররা ভর্তি হয়। ছাত্ররা যদি সেখানে ভর্তি না হত, তবে তারা আজকে এই সাহস করতে পারত না। ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ই্উজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক, তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। মন্ত্রণালয় যেভাবে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারে, আমরা সেটা পারি না। তারপরও আমরা নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু করব।

ইউজিসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ী মানসিকতা নিয়ে চলে। চলমান পরিস্থিতিতে এই মনোভাব পরিবর্তন না হলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের ছাত্র হারাবে। তিনি বলেন, করোনা সঙ্কটের কারণে সারাদেশের অবস্থা ভয়াবহ। পরিস্থিতি এমন নয় যে, ছাত্ররা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মুখিয়ে আছে। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি সদয় না হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তারা লাভের চেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে।

তিনি পরামর্শ দেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনোভাবেই স্বাভাবিকের মত ছাত্র-ছাত্রী পাবে না। তাই ছাত্রদের ওপর যত বেশি চাপ পড়বে, তত বেশি তারা ছাত্র হারাবে। তাই টিউশন ফি’সহ সবক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাড় দিতে হবে। 

অধ্যাপক শহীদুল্লাহ প্রশ্ন তোলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবকিছুর জন্য এত অস্থির কেন? কারণ, প্রতিষ্ঠানের সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেই তারা কিছু ফি পারে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কথাও তো ভাবতে হবে।

ইউজিসির নির্দেশনা ও করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যে খরচ রয়েছে তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করতে হবে। এখন এই মহামারির সময়ে শিক্ষার্থীদের উপর চাপ তৈরির ইচ্ছা বা লক্ষ্য আমাদেরও নেই।

ইউজিসি চেয়ারম্যানের ইনস্টলমেন্ট প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইনস্টলমেন্ট তথা কিস্তি একটি অপশন। সেটি কীভাবে এবং কত সময়ের মধ্যে আদায় করা যাবে; তা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। সামগ্রিক বিষয় নিয়েই আমরা ইউজিসি’র কাছে প্রস্তাবনা পাঠাব।

ওই ট্রাস্টি চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে, তাদের পরিবার আছে। তাদেরকে বেতন দিতে হয়। চাইলেও আমরা অনেক ক্ষেত্রে নমনীয় হতে পারি না। তারপরও ওয়েভার, স্কলারশিপসহ নানা ধরণের শিক্ষা-সুবিধা আমাদের রয়েছে।

এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির সভাপতি ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, শিক্ষামন্ত্রী সভার সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রম অনলাইনে চলবে, এটা ভালো সিদ্ধান্ত। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট নতুন এ সিদ্ধান্তে অনেকটাই কাটিয়ে উঠবে বলে মনে করি। এখন ইউজিসি যে গাইডলাইন করবে, সেখানে আমরা কিছু সুপারিশ তুলে ধরব।’

ক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা, চাওয়া এক সেমিস্টার ফি মওকুফ: এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির ত্রি-পক্ষীয় এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হবে। এক্ষেত্রে তারা ঢাকা থেকে গ্রামে বই না নিয়ে যাওয়া, দুর্বল  ইন্টারনেট কানেকশন, মানসিক অবস্থা ও লকডাউন পরিস্থিতিতের সৃষ্ট নানা বিষয় তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে দাবি তোলেন, এক সেমিস্টার ফি মওকুফের।

সৈয়দা মুনিয়া জান্নাত নামে এক শিক্ষার্থী বলছেন, কঠিন এই বিপর্যয়ে অনেকেই দেশগ্রামে আটকা পড়েছেন, যারা বইখাতা পর্যন্ত নিতে যেতে পারেনি। তাহলে গ্রামের এসব অসহায় শিক্ষার্থীরা কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা দেবে? তার ভাষ্য, শিক্ষাব্যবস্থার এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত দেখে হাজারো শিক্ষার্থীর পড়ালেখা থেকে মন উঠে গেছে। সিস্টেমের এমন মানসিক অত্যাচার বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রায়াত লাজিম নামে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা নিতে বলেছে। যে সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো সেমিস্টার ফি আদায়ের সুযোগ নিচ্ছে। ফলে আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কারণ, অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের পক্ষে সেমিস্টার ফি’র বোঝাবহন কোনভাবেই এই মুহূর্তে সম্ভব না।

এর আগে বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনলাইন বৈঠক হয়। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কমিটি তাদের পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল বিষয় ঠিক করবে। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা কীভাবে নেবে, সে বিষয়ে করণীয় ঠিক করে দেবে কমিশন। পাশাপাশি আগামী সেমিস্টারের ভর্তি কত তারিখ থেকে কত তারিখ পর্যন্ত চলবে; সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন দেবে। 

বৈঠকে ছাত্র-ছাত্রীদের মিডটার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষার বিষয়ে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কয়েকটি অপশন দেবে ইউজিসি। এ ক্ষেত্রে আগামী সেমিস্টারের শুরুতে বর্তমান সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতে পারে। এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে যেসব পদ্ধতিতে অনলাইন পরীক্ষা, সেই প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা যাবে।


সর্বশেষ সংবাদ