শ্রীলঙ্কার দুর্দিন: মেগা প্রকল্পের মেগা ভয়!

 লেখক- মো. মাহবুবুর রহমান
লেখক- মো. মাহবুবুর রহমান

২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার স্বাক্ষরতার হার ছিল ৯৬.৩%। মোটামুটি বিগত এক দশক ধরে সে দেশের বয়স্ক মানুষের গড় স্বাক্ষরতার হার ৯২% থেকে ৯৬% এর মধ্যে উঠানামা করেছে যা মানব উন্নয়ন রিপোর্ট -২০১৫ অনুযায়ী বিশ্ব ও আঞ্চলিক মানের থেকে উর্দ্ধে। মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখের মত জনসংখ্যারদেশে এতো বেশি শিক্ষিত জনগন নিয়ে এই রাষ্ট্রে কী এমন হলো যে তা এক প্রকার দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিনত হলো? তাও আবার এক প্রকার হঠাৎ করে ! সেখানে জ্বালানির সংকট চরম আকার ধারন করেছে। দিনে গড়ে ১০-১২ ঘন্টা লোড শেডিং হচ্ছে। পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ পর্যন্ত নেই।

বর্তমানে তাদের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে তাদের ১০ দিনের আমদানি মূল্য পরিশোধের ক্ষমতাও নেই। অর্থনৈতিক এই শোচনীয় অবস্থার প্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসলে প্রধানন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ব্যতীত বাকী ২৬মন্ত্রী এক সাথে পদত্যাগ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণরও পদত্যাগ করেছেন। সব শেষে কোন সমাধান না পেয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে বিরোধীদেরকেও সরকারে যোগদানের জন্য ডাকছেন, অথচ কেউ ই আর সরকারে আসতে চাইছেন না। সকলেই এখন ওই দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা পক্ষে পরিবারের আধিপত্যের অবসান চাইছেন। অথচ কিছুদিন আগেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাই সবচেয়ে এগিয়ে ছিল।

এমন মজবুত ভিতের উপর দাঁডিয়ে থাকা একটি দেশের ব্যাপারে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আর পতনের সুযোগ নেই। কিন্তু, ভুল অর্থনৈতিক নীতি, দূর্নীতি, পরিবার তন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার উত্তম প্রমাণ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার ভুল অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবীদেরা বেশ পূর্ব থেকেই সতর্ক করেছিল। তাদের সব থেকে বড় ভুল ছিল যাচাই-বাছাই না করে বড় বড় অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া। সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট বানানো হয়েছে কিন্তু তা আসলে অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভজনক হবে, তারা সেই বিবেচনা করেনি।

আরও পড়ুন: নিয়ম ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করা সম্ভব না

এসব বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেয়ে কখনও চীন, না পেলে কখনও ভারত থেকে ঋণ নিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর যে হারে অর্থনৈতিক রিফান্ড আসার কথা ছিলো তা আসেনি। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, আপনি ব্যাংক থেকে ২ কোটি টাকা ধার করে ভাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে ৩ তলা একটি বাড়ি বানালেন। বাড়ি বানানোর পর দেখলেন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে আপনি ব্যাংক থেকে যে ঋণ করেছেন সে টাকা শোধ করবেন কীভাবে? ঠিক একই ভাবে শ্রীলঙ্কার অনেক প্রকল্প আজ White Elephant বা শ্বেথহস্তীতে পরিণত হয়েছে। ফলে শ্রীলঙ্কা এখন আর দাতা রাষ্ট্রগুলোকে ঋণ শোধ করতে পারছেনা।

অবশ্য এ ক্ষেত্রে দাতা রাষ্ট্র সমূহেরও বেশ দোষ আছে। তারা প্রোজেক্ট এপ্রাইজাল বা প্রকল্প থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ভালভাবে হিসেব না করেই ঋণ দিয়ে দিয়েছে। যেমন, চীনের অর্থে তৈরী করা শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরের ঋণের অর্থ দিতে না পারায় বন্দরটি এখন চীনের কাছে বাধ্য হয়ে লিজ দিতে হয়েছে। আবার যেহেতু সেদেশের জনসংখ্যা কম, এ জন্যও তাদেরকে ভুক্তভুগি হতে হয়েছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তার থেকে লাভ করতে না পারার একটি অন্যতম কারণ জনসংখ্যা কম হওয়া বা বাজারে চাহিদা কম থাকা ।

ঋণগ্রহীতা দেশের অগ্রাধিকার কী সেটা অনেক সময় যাচাই করা হয় না। জমকালো কিছু করা বা বড় প্রকল্প করার মধ্যে অনেকটা লোকদেখানো ব্যাপার থাকে। চীনের অর্থায়নে কলোম্বতে একটি টাওয়ার হয়েছে-লোটাস টাওয়ার। বড় এই টাওয়ার দেখানোর জন্য হয়তো ঠিক আছে কিন্তু সে দেশের অর্থনীতিতে এর কোন অবদান নেই। ঋণ নেওয়া অর্থ তো ফেরত দিতেই হবে। এখন ঋণ করা প্রকল্প থেকে যদি লাভ না আসে, তাহলে কী অবস্থা হয় ভাবুন একবার। দূর্নীতি , গোষ্ঠীতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিবেচনার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা যাওয়ার পরও নীতিগত পদক্ষেপ না নিয়ে ঋণের মাধ্যমে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই একটি দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরী। তবে তা করার পূর্বে আপনার দেশের মূল ধারার ব্যবসা –বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হয়। ধরুন, আপনি আইসক্রীম ফ্যাক্টরী দেওয়ার জন্য বিল্ডিং করে বসলেন। অথচ আপনার আইসক্রীমের ব্যবসা এখনও প্রস্তুত না। অথাবা আইসক্রীম উৎপাদন করার পর দেখলেন বাজারে এর চাহিদা নেই। উপায়ন্তর না দেখে বিদেশে রপ্তানি করতে চাইলেন, কিন্তু তাও করতে পারলেন না।

তাহলে এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন এক প্রকার বিফলে গেলো না? একইভাবে, শ্রীলঙ্কার অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে মূলধার অর্থনীতি খুব বিবেচনার মধ্যে ছিলো না তা হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও লোটাস টাওয়ার এর দৃষ্টান্ত থেকেই বুঝা যায়। আবার দেশের জনসংখ্যা কম বা মাত্র ২ কোটি হওয়া স্বত্বেও তাদের শিল্পায়নকে রপ্তানি বহুমুখি করার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যার কারণে শিল্পায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন কোন কিছুই কাজে আসেনি তাদের জন্য।

এখন, প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের জন্য শ্রীলঙ্কার এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছু করার আছে কি? এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভীত হওয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি?

বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবথেকে বড় একটি আশীর্বাদ হলো আমাদের বিশাল জনসংখ্যা। আমাদের নিজস্ব বিরাট একটি বাজার আছে। যার দরুণ বড় বড় প্রকল্প থেকে লোকশান হওয়ার সম্ভাবনা কম। যেমন , পদ্মা সেতু থেকে যে পরিমান টোল আদায় হবে তাতে এ প্রকল্প থেকে লোকশান হওয়ার সুযোগ নেই । আবার, পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যে যোগাযোগ ও বানিজ্যিক সুবিধার দুয়ার খুলবে তাতে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

সে হিসেবে, সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও ভাল অবস্থানে আছে। তবে পরিস্থিতি কিন্তু আগের চেয়ে দুর্বল হতে শুরু করেছে। সামষ্টিক অর্থনীতি আগের মত শক্ত নেই। দেশের চলতি হিসাবে শ্রীলঙ্কার মত আমাদেরও বিশাল ঘাটতি আছে। সামনে যে ঘাটতি হতে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এর আগে কখনও এর অর্ধেক ঘাটতিও হয় নি। সুতরাং, কিছুটা উদ্বেগের জায়গা তৈরী হয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে আমাদেরকে প্রধানত তিনটি জায়গায় বিশেষ নজর দেওয়ার দরকার। প্রথমত, বাণিজ্য ঘাটতি যথাসম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসা। বিশেষত চীন ও ভারতের সাথে আমাদের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা কমানো প্রয়োজন। বিনিময় হারে যে সমন্বয় দরকার ছিলো, তা নেওয়া হয় নি। আমাদের আমদানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ হারে। এই হারে যদি বাড়ে , তবে চলতি অর্থবছর শেষে আমদানি ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের মত হয়ে যাবে ।

বিনিময়ে আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে কতটুকু হারে? এর আগে আমাদের ৬০ বিলিয়ন বা ৬ হাজার কোটি ডলাররের বেশি আমদানি ব্যয় কখনোই হয়নি। সুতরাং এতোটা বেড়ে গেলে সেই চাপ সহ্য করাটা কঠিন হবে। আর বৃদ্ধির এই প্রবণতা যদি আরও এক বছর চলে , তবে আমাদের বৈদেশিক মূদ্রার মজুত এক প্রকার শেষের দিকে চলে আসবে বা ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে।

দ্বিতীয়ত, বড় বড় প্রকল্পগুলোর ব্যপারে সাবধান হওয়া। আমাদের দেশের চলমান প্রকল্পগুলো অধিকাংশই ভালো। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে যা পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত হানতে পারে। যেমন, পদ্মা সেতু নিশ্চয় অনেক ভাল প্রকল্প। কিন্তু পদ্মা সেতুতে রেললাইন প্রকল্প অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রকল্প। পদ্মা সেতুতে যেখানে খরচ হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা, সেখানে রেললাইন করতে খরচ হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: আমাদের গালভরা বুলি সমৃদ্ধ মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রী এদের চেনেই না

অথচ এই রেল পথ দিয়ে যেসব পণ্য আসবে, তার জন্য নৌপথ রয়েছে। আবার কক্সবাজার থেকে রামুতে রেল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখানে কী চলবে? মিয়ানমারের সাথে তো আমাদের তেমন বাণিজ্য নেই। অথচ এ প্রকল্পে আমাদের ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। মোদ্দাকথা, খেয়াল রাখতে হবে, প্রকল্পের উপযোগিতা যেন ভাল হয় আর প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের অপচয় যেন না হয়।

তৃতীয়ত, আমাদের দেশের স্বাক্ষরতার হার বাড়ছে। সাথে বাড়ছে বেকার জনসংখ্যা। আজ শ্রীলঙ্কা বেকায়দায় পড়েছে জনসংখ্যা কম হওয়ায়। অন্যদিকে, আমাদের জনসংখ্যা বেশি আছে, যার ফলে বিরাট একটি বাজার আছে। এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। চাকুরীর সেক্টরগুলো যেন আমলামুখী না হয়ে পড়ে, বরং কর্মসংস্থান হতে হবে উৎপাদনমুখী। দেশে উৎপাদন বাড়লে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। উৎপাদনে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানীর উপর জোর দিতে পারলে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য হারে সফল হতে পারলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। বেকার সমস্যা দূর হবে। পরের কাছে হাত পাতা থেকে রেহায় পাওয়া যাবে।

সর্বপরি, অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক থাকলে দেশ ঠিক থাকবে। শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি পরিহার করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন আমাদের প্রতিটি প্রকল্পের বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার মতো লাভজনক হয়। শ্রীলঙ্কা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই শিক্ষায় দিচ্ছে।

লেখক: আইন কর্মকর্তা, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড।


সর্বশেষ সংবাদ