সাত কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে গঠিত ও পরিচালিত হতে পারে
- সাঈদুর রহমান তানভীর ও ইলিয়াস শান্ত
- প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১০ PM , আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৫ PM
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেড় সহস্রাধিকেরও বেশি প্রাণের বিনিময়ে আমরা এক নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এ আন্দোলনে প্রাণ উৎসর্গকারী সকল বীর শহীদদের আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। নতুন বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন খাতে চলমান বৈষম্য নিরসন করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা বৈষম্যের অবসানের দাবি তুলেছেন।
আপনারা জানেন, শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকার রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করেছে। তবে যে উদ্দেশ্যে এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে, দীর্ঘ প্রায় আট বছরেও সেটা প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। অধিভুক্ত এই কলেজগুলোর শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, আবাসন সংকট, পরিবহণ সংকট, ল্যাব সংকটসহ এসব সংকট সমাধানে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পাশাপাশি, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা এবং পরীক্ষায় উপস্থিত থাকার পরও অনুপস্থিত দেখানোর মতো জটিলতা এখনো রয়ে গেছে।
এসব সমস্যার সমাধানে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা শুধু মাত্র সাত কলেজের সমন্বয়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুলেছেন। একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অধিভুক্তি বাতিলের দাবি তুলেছেন। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষ (২০২৪-২৫) থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করার মাধ্যমে অধিভুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অধিভুক্তি বাতিলের সঙ্গে সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘সাত কলেজ নিয়ে নতুন একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে’। আমরাও মনে করছি, সরকার চাইলে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এজন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ান ও যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের কাঠামো পর্যালোচনা করেছি। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামো পর্যালোচনা করে আমরা মনে করছি, সাত কলেজের সমন্বয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও এসব কলেজে এখনো স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মতো কাঠামো তৈরি হয়নি। দেশীয় প্রেক্ষাপটে সাত কলেজের সমন্বয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটি প্রাথমিক প্রস্তাবনা তুলে ধরছি, যা শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সুষ্ঠু প্রশাসন নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।
প্রস্তাবনা
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে প্রথম আকর্ষণ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান তৈরির সঙ্গে নামকরণেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জুলাই-আগস্টে দেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা যেতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কেন্দ্রিক নামেও গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করলে সবচেয়ে ভালো হবে।
কলেজগুলোর নাম
কলেজগুলোর নাম দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এ কারণে এসব কলেজের নাম পরিবর্তন করা উচিত হবে না। একান্তই যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে পূর্বের নামের সঙ্গে মিল রেখে নতুন নামে নামকরণ করা। উদাহরণস্বরূপ: ঢাকা কলেজ অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি অথবা ইডেন কলেজ অব ক্রিয়েটিভ আর্টস অ্যান্ড টেকনোলজি। এই ধরনের নামগুলো ঐতিহ্য বজায় রাখার পাশাপাশি আধুনিকতার সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করবে।
কলেজগুলোর স্বকীয়তা
কলেজগুলোর স্বকীয়তা সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কলেজগুলোর কাঠামো এবং শিক্ষাগত পরিবেশ পরিবর্তিত হতে পারে। তবুও কলেজগুলোর ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: ঢাকা কলেজ বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী ছেলেদের কলেজ হিসেবে পরিচিত এবং ইডেন মহিলা কলেজ পরিচিত মেয়েদের কলেজ হিসেবে। এসব কলেজের বিশেষ চরিত্র, ইতিহাস এবং স্বকীয়তা রয়েছে। যা কলেজগুলোর বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে গর্বের অনুভূতি তৈরি করে।
প্রশাসনিক কাঠামো
প্রাথমিক পর্যায়ে সাত কলেজের যেকোনো একটি কলেজের প্রশাসনিক ভবনকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে বিবেচনা করে কাজ পরিচালনা করা যেতে পারে। পরবর্তীতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাত কলেজের বাইরে একটি স্বতন্ত্র স্থানে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করতে হবে। নতুন ভবন স্থাপিত হলে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
অনুষদ বণ্টন
প্রতিটি কলেজে সর্বোচ্চ দুইটি করে অনুষদ রাখা যেতে পারে। প্রয়োজন সাপেক্ষে কোনো কোনো কলেজে একটি করে অনুষদ রাখা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ওই অনুষদভিত্তিক নতুন বিভাগ খুলতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং কলেজগুলোতে যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ বাড়বে। বর্তমানে সবগুলো কলেজে তিনটি করে অনুষদ রয়েছে। তাই সময়ের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নতুন বিভাগ সংযোজনের জন্য কলেজগুলোতে একটি বা দুটি করে অনুষদ রাখা একটি কার্যকরী ব্যবস্থা হতে পারে। নতুন বিভাগগুলো যেমন হতে পারে:
> কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই)
> ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই)
> ডেটা সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স
> স্টার্টআপ ম্যানেজমেন্ট
এই প্রস্তাবনাটি যদি নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যকর করা হয়, তবে এটি কলেজগুলোর শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও আধুনিক এবং সুশৃঙ্খল করবে। যা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
শিক্ষক প্রসঙ্গ
সাত কলেজের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আলোচনার সঙ্গে কলেজগুলোর শিক্ষকদের বিষয়টি বারবার সামনে আসছে। শিক্ষকদের নিজেদের মাঝেও আমরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করেছি। তাই আমরা শিক্ষকদের প্রসঙ্গে একাধিক প্রস্তাবনা তুলে ধরছি:
বর্তমান শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ: কলেজগুলোতে যেসব শিক্ষক কর্মরত আছেন, তাদেরকে প্রাথমিকভাবে প্রেষণে অন্তত ৩-৫ বছরের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এই সময়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পূরণ করার সুযোগ পাবেন। যারা এই মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম হবেন, তাদেরকে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া যাবে। বাকিদেরকে তাদের পূর্ববর্তী কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে রাখা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: জগন্নাথ কলেজকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সময় জগন্নাথ কলেজের ২২০ জন শিক্ষককে প্রেষণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ: সাত কলেজের যেসব শিক্ষক বর্তমানে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন, তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। আর সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকদের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে রাখা যেতে পারে।
স্থায়ী নিয়োগ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: সাত কলেজে কর্মরত সব শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। যাদের স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক শিখন পদ্ধতি, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হবে।
শিক্ষকদের বদলি নীতি: বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনুষদভিত্তিক এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে বদলি করা যেতে পারে। যেসব কলেজগুলোতে কলা অনুষদ থাকবে, পর্যায়ক্রমে ওইসব কলেজে বাকি কলেজগুলোর কলা অনুষদভিত্তিক বিভাগের শিক্ষকদের কলা অনুষদের কলেজগুলোতে বদলি করা। নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে একটি বা দুটি অনুষদভিত্তিক শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হলে এবং ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা অনুযায়ী শিক্ষকদের এ বদলি কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে।
শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমলা অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া, যাতে করে শিক্ষার গুণগত মানের দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধিত হয়।
অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গ
সাত কলেজে অধ্যয়নরত স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা যেন কোনো ধরনের সেশন জটিলতায় না পড়েন, এ বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ ২০১৭ সালে সাত কলেজকে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ঢাবির অধিভুক্তি করার ফলে সেশনজট, ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রীতাসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়। এখন অধিভুক্তি বাতিল ও নতুন কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ায় সেরকম জটিলতা এড়াতে পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সাত কলেজের এসব শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ধারাবাহিকভাবে চলমান রাখতে হবে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ঢাবি থেকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হবে। এমনকি বর্তমানে যে শিক্ষার্থী যে কলেজে অধ্যয়নরত আছেন, তিনি ওই কলেজ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করবেন। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হবে না, অন্যদিকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়াও সহজতর হবে।
নতুন ভর্তি কার্যক্রম
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার জন্য একটি সুসংগত পদ্ধতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এ প্রেক্ষাপটে নতুন ভর্তি কার্যক্রম নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা অনুসারে পরিচালনা করা যেতে পারে:
অনুষদভিত্তিক ভর্তি: নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদভিত্তিক ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। যেমন: ইডেন কলেজে যদি শুধুমাত্র বিজ্ঞান অনুষদ থাকে, তাহলে সেখানে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের ভর্তি করা হবে। একইভাবে, অন্যান্য কলেজেও অনুষদভিত্তিক ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।
অবকাঠামো অনুযায়ী আসন: বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা উচিত। প্রয়োজনীয় জায়গা ও ব্যবস্থাপনার সুবিধা অনুযায়ী আসন সংখ্যা কিছুটা কমানো যেতে পারে। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সেবা প্রদান করা সম্ভব হয় এবং অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।
ভর্তি নীতিমালা: ভর্তি নীতিমালা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পরেই সম্পন্ন করা যেতে পারে। ভর্তি প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সহজ হয়, তার জন্য একটি আধুনিক ও কার্যকরী নীতিমালা তৈরি করা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তির শর্তাবলি, আবেদন পদ্ধতি, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
উচ্চ মাধ্যমিক প্রসঙ্গ
সাত কলেজের মধ্যে যে পাঁচটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নরত আছেন, তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন ও কার্যক্রম নিয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এসব কলেজগুলোর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনার গৌরবোজ্জ্বল অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও সে কারণে উচ্চ মাধ্যমিক লেভেল বাদ না দেওয়াই শ্রেয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে উচ্চ মাধ্যমিককে সম্পূর্ণ পৃথক বডি ও পৃথক ভবনের মাধ্যমে পরিচালনা করা।
উদাহরণস্বরূপ: বুয়েটের অধীনে বুয়েট কলেজ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালিত হচ্ছে, তেমনি এই পাঁচটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগও পৃথকভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে। অথবা বর্তমানের মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেও রাখা যেতে পারে। এই ধরনের ব্যবস্থা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আরও উন্নত শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করবে।
কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রসঙ্গ
সাত কলেজে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন। এই কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করার জন্য রেজিস্ট্রার দপ্তর, জনসংযোগ দপ্তর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরসহ সকল দপ্তরে পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশেষ করে পরীক্ষা দপ্তরে নিয়োগ কার্যক্রমে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের স্থানান্তরিত করার সময় যাতে কোনো ধরনের প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি না হয়।
এই দায়িত্বে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে সাত কলেজের বর্তমান সহকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তারা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও কাজের ধরন সম্পর্কে পরিচিত থাকায় কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে। পরবর্তী সময়ে, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় তাদের স্থায়ী নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে।
অধিভুক্তি বাতিল
সাত কলেজের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু হওয়ার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করতে হবে। কারণ আগেই অধিভুক্তি বাতিল করলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে করতে এসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। সুতরাং, সাত কলেজের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সব ধরনের কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানের ন্যায় চালিয়ে নেবে। সাত কলেজের সমন্বয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো তৈরি হয়ে গেলে তখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এসব শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেবে। এতে করে সাত কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের সংকট তৈরি হবে না।
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণভাবে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ২০:১ অথবা ২৫:১ হওয়া উচিত। তবে এটি নির্ভর করে শিক্ষকের অভিজ্ঞতা, শিক্ষার্থীর প্রয়োজন এবং বিভাগ বিশেষের ওপর। একটি অত্যন্ত ভারী ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, যেমন ৫০:১ বা তার বেশি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মান কমাতে পারে এবং শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষতি করতে পারে। এটি শিক্ষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে তাঁদের শিক্ষাদানে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আরও ব্যক্তিগত সহায়তা পাওয়া কঠিন হতে পারে। সুতরাং, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের সঠিক ভারসাম্য গড়ে তোলা উচিত। যা শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখবে এবং শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট নিশ্চিত করবে।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতি সংগঠন
সাত কলেজের সবগুলো কলেজে বর্তমানে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ থাকলেও সেগুলো সচল নয়। সাত কলেজের সমন্বয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বর্তমানের ন্যায় ইউনিটভিত্তিক প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠন, ছাত্র সংসদ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম চলমান থাকবে। কেননা, কলেজগুলোর ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা কোনো কিছুই পরিবর্তন করা হবে না। এজন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও চলমান এসব কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর প্রয়োজন সাপেক্ষে সব ধরনের সংগঠনের কেন্দ্রীয় শাখা করা যেতে পারে। এর বাইরে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের যেসব সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে, সেগুলো বর্তমানের ন্যায় সচল থাকবে।
অবকাঠামো
নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজগুলোতে অনুষদভিত্তিক ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করা ও অবকাঠামো অনুযায়ী আসন সংখ্যা সীমিত করে আনা। এতে বর্তমান অবকাঠামোর মধ্যেই দু’একটি কলেজ ছাড়া বাকি কলেজগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষাদান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন ল্যাব নিশ্চিত করলে এই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। পরবর্তীতে নতুন বিভাগ খোলার পাশাপাশি আসন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অ্যাকাডেমিক ভবনও নির্মাণ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া কলেজগুলোতে বর্তমানে যে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। পর্যায়ক্রমে কলেজগুলোতে নতুন অবকাঠামো তৈরি করে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কলেজগুলোতে এভাবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
কোর্স কারিকুলাম
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলাম শিক্ষার মান উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এজন্য নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে বর্তমানের কোর্স কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় করে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। এই কারিকুলামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
কোর্সগুলোতে ফর্মেটিভ অ্যাসেসমেন্টের পাশাপাশি পিয়ার অ্যাসেসমেন্ট, প্রেজেন্টেশন এবং প্র্যাকটিক্যাল প্রোজেক্ট অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের কাজের মান নির্ধারণ করতে পারেন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারেন। এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গাইডেন্স ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ প্রদান করে তাদের প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারের জন্য গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী