৩১ শতাংশ আদিবাসী মেয়ের শিক্ষায় বাধা দারিদ্র্য ও সাংস্কৃতিক সংকট
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৯ PM
বাংলাদেশের সমতল ভূমির আদিবাসী নারী শিক্ষার্থীরা এখনও নানামুখী সংকটের মুখোমুখি। দারিদ্র্য, সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা, লিঙ্গ বৈষম্য এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামো তাঁদের শিক্ষার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব কারণে তাঁদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার এবং শিক্ষার মান নিচের দিকে রয়েছে।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) ‘আদিবাসীসহ বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মেয়েদের শিক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় গণস্বাক্ষরতা অভিযানের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বাগদি (বুনো) এবং সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা, বুনা, মালো, মাহালি, খোন্দো, বেদিয়া, ভূমিজ, কোলে, তুরি, ভীল, কর্মকার, মাহাতো, মুরিয়ার, মুসোহর, পাহান, পাহাড়িয়া, রাই এবং সিং সম্প্রদায়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে।
গণস্বাক্ষরতা'র যৌথ এ জরিপে আদিবাসী নারী শিক্ষার্থীদের ৩১ দশমিক ৩ শতাংশের বিদ্যালয়ে না যাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ হার প্রান্তিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি নওগাঁ জেলায়, ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন হবিগঞ্জে, ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।
আরও পড়ুন: সংকটে উদ্বেগ বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের, কমেছে উপস্থিতি
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণেও পিছিয়ে পড়ছে নারী শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, নওগাঁয় ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং গাইবান্ধায় ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষালয়ে না আসার কারণ হিসেবে আরও বলা হয়েছে, অনেক শিশু আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহীতে ২৪ শতাংশ এবং দিনাজপুরে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্কুলে উপস্থিতির উপর প্রভাব ফেলেছে এ কারণ।
আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর নারী শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের সংকট জরিপে তুলে ধরা হয়েছে। এতে শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে সমতল ভূমির জাতিগত সম্প্রদায়ের আদিবাসী মেয়েরা দারিদ্র্য, সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা, লিঙ্গ বৈষম্য এবং অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর মতো বাধার সম্মুখীন হয়, যার ফলে উচ্চ ঝরে পড়ার হার এবং খারাপ শিক্ষাগত ফলাফল পাওয়া গেছে।
এছাড়া বাল্যবিবাহ, গার্হস্থ্য দায়িত্ব, ভাষার প্রতিবন্ধকতা, উচ্চ খরচ, অনিরাপদ পরিবহন, এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করে। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থায় ন্যূনতম আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব, শিক্ষকের সংবেদনশীলতা এবং বৈষম্যমূলক মনোভাবের উপস্থিতি নিরুৎসাহিত করা এবং সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির অভাবের বিষয়গুলোও উঠে এসেছে জরিপে।
আরও পড়ুন: সহিংসতায় প্রাথমিক স্তরে উপস্থিতি কমেছে ৩৭ শতাংশ, ভীতিগ্রস্ত ৫৫.২ শতাংশ শিক্ষার্থী
নীতিগত ঘাটতি হিসেবে জরিপে সরকারী উদ্যোগ, আদিবাসী-ভাষার পাঠ্যপুস্তক, অনিরাপদ স্কুল পরিবেশ এবং দারিদ্র্যসহ বৈষম্য মোকাবেলায় অপর্যাপ্ততা তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রমের অনুপস্থিতি এবং সীমিত পরিসরে নারীদের অংশগ্রহণ আদিবাসী মেয়েদের আরও বিচ্ছিন্ন করে।
সংকটের সমাধান হিসেবে জরিপে সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, সাঁওতাল, ওরাওঁ এবং মাহালির মতো সমতল ভূমির আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে সমস্ত প্রধান আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিকাশ ও বিতরণ, বোধগম্যতা এবং ব্যস্ততা উন্নত করতে আদিবাসী ভাষা এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং নারী শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও আদিবাসী নারীদের শিক্ষকতা পেশা এবং তাদের সম্প্রদায়ে কাজ করার জন্য বৃত্তি এবং প্রণোদনা প্রদান বৃদ্ধি, নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক উদ্বেগ মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যন্ত এবং অনুন্নত এলাকায় মহিলা শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিতের সুপারিশও জানানো হয়েছে একই জরিপে।
একই সাথে জরিপে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং নিরাপদ শিক্ষার প্রচার, শিক্ষাগত অবকাঠামো উন্নত করা, অর্থনৈতিক সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা এবং বৈষম্যের সমাধানের পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রাথমিকে আরও তিন ক্যাটাগরিতে শিক্ষক নিয়োগের চিন্তা আছে: উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায়
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো'র মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), মো. ইউনুছ আলী। বক্তব্যে তিনি বলেন, এখানে নারী শিক্ষার্থীরাই নয় আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্য শিক্ষার্থীরাও সংকটে রয়েছে। এর জন্য তিনি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি না থাকাকে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং সরকারি পর্যায়ে আরও বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, আদিবাসীদের 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' না বলার আহ্বান জানান। পাশাপাশি মতবিনিময় থেকে পাওয়া পরামর্শগুলো সরকারি পর্যায়ে পাঠিয়ে তা নীতি-কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টার বিষয়েও জানান তিনি।
সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য এবং কর্মসূচির উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযান'র উপ-পরিচালক তপন কুমার দাশ। এতে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরেন গণস্বাক্ষরতা অভিযান'র উপ-পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিংয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহাদৎ হোসেন, আদিবাসী মুক্তি মোর্চা'র সভাপতি অধ্যাপক যোগেন্দ্র নাথ সরেন এবং বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা।