ঢাকার রাস্তায় ‘ইউএন’ লেখা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান, যা বলছে জাতিসংঘ

ইউএন লেখা সাজোয়া যান
ইউএন লেখা সাজোয়া যান  © সংগৃহীত

বাংলাদেশে বিক্ষোভ দমনের জন্য কারফিউ জারির পর ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দেবার সময় ইউএন (ইউনাইটেড নেশনস) লেখা সাঁজোয়া যান ব্যবহার নিয়ে শোরগোল তৈরি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে- ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যান যাচ্ছে। সেটির রং সাদা এবং সেখানে ইউএন (ইউনাইটেড নেশনস) লেখা রয়েছে।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সরঞ্জামে ‘ইউএন’ লেখা থাকে এবং সেসব সামরিক সরঞ্জাম সাদা রং-এর হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘ইউএন’ লেখা এবং সাদা রং-এর সাঁজোয়া যান ব্যবহার নিয়ে এখন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘ মহাসচিব স্টেফান ডুজারিক-এর নজরেও আনা হয়েছে। জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিককে এ সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন করেন বাংলাদেশি এক সাংবাদিক।

জবাবে মি. ডুজারিক বলেন, জাতিসংঘের নির্ধারিত কাজ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে ‘জাতিসংঘ’ লেখা যানবাহন ব্যবহার করা যায় না।

“বাংলাদেশে আমাদের সহকর্মীরা জাতিসংঘ লেখা বাহন চলমান ঘটনা প্রবাহের সময় ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। আমরা এটা গুরুত্ব সহকারে বলতে চাই যেসব দেশ জাতিসংঘে সেনা ও পুলিশ সদস্য পাঠাচ্ছে সেসব দেশ যাতে শুধু জাতিসংঘের কাজ করার ম্যান্ডেট আছে সেখানেই কেবল জাতিসংঘ লেখা বাহন ব্যবহার করতে পারবে,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন মি. ডুজারিক।

বিষয়টি নিয়ে বুধবার কথা বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন জায়গা ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের ঘুরিয়ে দেখায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এরপর পররাষ্ট্র হাসান মাহমুদ সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যানে ‘ইউএন’ লেখা ছিল। ‘ভুল করে’ জাতিসংঘের লোগো সম্বলিত গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে এই গাড়ি (সাঁজোয়া যান) জাতিসংঘের নয়, বাংলাদেশের বলে উল্লেখ করেন তিনি।

হাছান মাহমুদ বলেছেন, জাতিসংঘের কোনো গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে না। গাড়িগুলো জাতিসংঘ শান্তি মিশনে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। সেই গাড়ির লোগোগুলো ভুল করে মুছা হয়নি। এখন সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে।

কারফিউ জারির পরে ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর প্রচুর সাঁজোয়া যান দেখা গেছে। এর মধ্যে বহু সাঁজোয়া যান ছিল সাদা রং-এর।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাদা রং-এর এসব সাঁজোয়া যান হয়তো সম্প্রতি জাতিসংঘ মিশন থেকে ফিরেছে নতুবা কোন মিশনে যাওয়ার প্রস্তুতিতে আছে। সেজন্য এগুলোতে সাদা রং রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য বিবিসির তরফ থেকে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরে ইমেইল করা হলেও কোন উত্তর মেলেনি।

বাংলাদেশের আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সালে শুরু হওয়া শান্তিরক্ষা মিশন শুরু হবার পর থেকে এখনো পর্যন্ত তারা ৪০টি দেশ ও স্থানে ৬৩টি শান্তিরক্ষা মিশন শেষ করেছে।

এসব মিশনে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার সদস্য বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী থেকে অংশ নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় সাত হাজার শান্তিরক্ষী রয়েছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন এমন একজন ঊর্ধ্বতন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যখন যেখানে শান্তিরক্ষা মিশনে যায়, তখন সেখানে জাতিসংঘ নির্ধারিত সামরিক ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে যায়। এসব সরঞ্জামের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ভাড়া দেয়।

সরঞ্জাম আনা-নেয়া ও মিশনে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও জাতিসংঘ অর্থ দেয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে।

“প্রতিটি জিনিস ব্যবহার করার জন্য জাতিসংঘ অর্থ দেয়। যে কোন মিশনে যাবার আগে জাতিসংঘের তরফ থেকে বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয়া হয় যে কোন ধরণের সরঞ্জাম লাগবে। এর একটি তালিকা দেয়া হয়। বাংলাদেশ সেসব সরঞ্জাম নিয়ে যায় এবং জাতিসংঘ এর বিপরীতে ভাড়া দেয়। মিশন শেষ হলে সেসব সরঞ্জাম দেশে ফেরত আনা হয়,” বলেন সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা।

শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সাথে জাতিসংঘের চুক্তি দুই রকমের হতে পারে। একটি হচ্ছে ‘ওয়েট লিজ’ ব্যবস্থা এবং অপরটি হচ্ছে ‘ড্রাই লিজ’ ব্যবস্থা।

‘ওয়েট লিজ’ ব্যবস্থার আওতায় যেসব দেশ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য পাঠায় তারা বড় ধরণের সরঞ্জাম দেয় এবং সেগুলো নিজেরাই রক্ষণাবেক্ষণ করে। এজন্য যে অর্থ খরচ হয় সেটি জাতিসংঘ তাদের পরিশোধ করে।

‘ড্রাই লিজ’ ব্যবস্থার আওতায় সংশ্লিষ্ট দেশ সৈন্য পাঠানোর পাশাপাশি বড় ধরণের সরঞ্জামও পাঠায়। কিন্তু সেসব সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হচ্ছে জাতিসংঘের। অন্য কোন দেশ কিংবা ঠিকাদারদের মাধ্যমে এসব কাজ করে জাতিসংঘ।

রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যার হোক না কেন, যেসব দেশ সরঞ্জাম পাঠায় সেগুলোর জন্য অর্থ দেয় জাতিসংঘ।

মিশন শেষ হবার পরে সংশ্লিস্ট সরঞ্জাম নিজ দেশে নিয়ে আসে। এরপর সেনাবাহিনী নিজ দেশে সেগুলো ব্যবহার করতে পারে কিংবা অন্য কোন শান্তি রক্ষা মিশনে এসব সরঞ্জাম নিয়ে যেতে পারে। তবে জাতিসংঘের কাজে নিয়োজিত না থাকলে ‘ইউএন’ লেখা থাকতে পারবে না।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, যেসব সরঞ্জামে সাদা রং দেয়া আছে সেগুলোর জন্য জাতিসংঘ ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে অর্থ দিয়েছে।

“সরকার জাতিসংঘের কাছ থেকে যে অর্থ পায় সেটি ফরেন কারেন্সি হিসেবে আসে,” বলেন মি. হোসেন।

জাতিসংঘ মিশনে কিভাবে সেনা মোতায়েন হবে, জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র এবং আর্থিক দিকগুলো কিভাবে পরিচালিত হবে সেটি নিয়ে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী দেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতা স্মারক রয়েছে।

১৯৯৬ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত একটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী দেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হয়েছে।

এই সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে সবকিছু নির্ধারিত হয়। শান্তিরক্ষা মিশনে কোন ধরণের সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে, সৈন্যদের থাকার জন্য কোন ধরণের জিনিসপত্র লাগবে – এসব বিষয় সমঝোতা স্মারকে থাকে।

যেসব দেশ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয় তারা কীভাবে জাতিসংঘের কাছ থেকে অর্থ নেবে সেটিও উল্লেখ আছে সমঝোতা স্মারকে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, পৃথিবীর কোন দেশে শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করা হবে সে সিদ্ধান্ত নেয় নিরাপত্তা পরিষদ।

শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেটি জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জাতিসংঘ চার্টারের আর্টিকেল ১৭ তে বলা হয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র তাদের সম্পদ ও আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে।

তবে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র যেমন – আমেরিকা, চীন, ব্রিটেন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স – বড় আকারে অর্থের জোগান দেবে। কারণ আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

কোন দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত যখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাশ করা হয় তখন সে দেশে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে সেখানকার চাহিদা নিরূপণ করা হয়। অর্থাৎ কত সৈন্য লাগবে, কি ধরণের সামরিক সরঞ্জাম লাগবে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র – ইত্যাদি বিষয়।

২০২১ সালের পহেলা জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ শে জুন পর্যন্ত এক বছরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের বাজেট ছিল প্রায় সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার।

২০২০-২০২১ অর্থ বছরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়েছে তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবার ওপরে। মোট বাজেটের প্রায় ২৮ শতাংশ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রয়েছে চীনের অবস্থান। শান্তিরক্ষা মিশনের মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ দিয়েছে চীন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপান, তারা মোট বাজেটের সাড়ে আট শতাংশ দিয়েছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মিশনে অংশ নেয়া সেনা সদস্যদের পদমর্যাদা এবং বেতন-ক্রম অনুযায়ী বেতন দেয় সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। সেই অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার জাতিসংঘের কাছ থেকে নেয়। এখানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ দ্বারা নির্ধারিত একটি মান রয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের বেতন দেয়া হয়।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের পহেলা জুলাই একজন সৈন্যকে ১৪২৮ ডলার বেতন দেয়া হতো।

এছাড়া মিশনে অংশ নেয়া দেশগুলো যেসব সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে সেটির অর্থও দেয় জাতিসংঘ।

 

সর্বশেষ সংবাদ