বরিশাল মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন সৌরভ, ভর্তি হতে পারবেন তো?

শিক্ষার্থী সৌরভ হাওলাদার
শিক্ষার্থী সৌরভ হাওলাদার  © সংগৃহীত

সকল বাধা বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে এবার ২০২২-২০২৩ সেশনে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন বরিশাল জেলার উজিরপুরের নারায়নপুর গ্রামের দিন মজুরের ছেলে মেধাবী শিক্ষার্থী সৌরভ হাওলাদার। সৌরভ ১২৯৯ তম স্থান লাভ করেছেন তার প্রাপ্ত নাম্বার ৭২.৭৫। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে এতদূর এগিয়ে আসার পরও অর্থ-সংকটে তার মেডিকেলে ভর্তি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে সৌরভের। 

সৌরভের পরিবারের বসবাস উজিরপুরের নারায়নপুরে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সৌরভ সবার ছোট। অন্যের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে শিক্ষকদের সহায়তায় সৌরভ প্রস্তুতি নিয়ে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। 

বাবা বিগত দিনগুলোতে দিনমজুরের কাজ করে সৌরভের পড়াশুনার খরচ চালাতেন। ছোট থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা সৌরভের ভালো কোনও স্কুলে পড়ার সুযোগ ছিল না। প্রাথমিকে লেখাপড়া করেছেন গ্রামের পূর্ব নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুলে। 

মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সৌরভ ডেইলি ক্যাম্পাস কে বলেন,  গ্রামে প্রচলিত একটা কথা আছে, ক্লাসে রোল নাম্বার ১,২ যাদের হয় তাদেরই সব সময় ভালো ছাত্র হিসেবে ধরে নেয়া হয় সমাজে।  সমাজের প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষায় ৪.৫৮ পেয়েছিলাম। তাই  তখন ভালো ছাত্র হিসেবে গণ্য হতে পারি নাই।

এরপর  মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম নারায়ণপুর পল্লী ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে। সেখানে শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে সেই হতাশা কেটে গেল। তাদের আশীর্বাদে জিএস সি পরীক্ষা ও এসএস সি পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি আসছিল। দশম শ্রেণীর এস এস সি পরীক্ষার আগে আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সংকরি মন্ডল একটা কথা বলেছিল। বাবা আর যাই হোক না কেনো তোমাকে ডাক্তার হতেই হবে। চার বছর আগে ম্যাডামের সেই কথা এখনও আমার কানে স্পষ্ট শুনতে পাই। তার সেই উপদেশ সব সময় স্মরণ করি। এটাই ছিল আমার অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। 

২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর ভর্তি হই গুঠিয়া আইডিয়াল কলেজে। কোভিড -১৯ চলায় সরাসরি ক্লাস বেশি একটা করার সুযোগ হয় নাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চালু হলো অনলাইন ক্লাস নেওয়া। আমার ক্লাসের এক স্যার জনাব সাইফুল ইসলাম আমার মা কে ফোন দিয়ে আমাকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেওয়ার কথা বলেন। তখন বাবার মাথায় আবারও চিন্তা এসে গেলো টাকা জোগাড়ের। কই পবে এতো টাকা।

বাবা দিন মজুরের কাজ করে প্রতিদিন তিনশত টাকা পেতেন।  তখন করোনা মহামারী থাকায় বাবার কাজ কর্ম ও বন্ধ হয়ে যায়। আমি  তখন টিউশনি করাতাম। টিউশানির টাকা জমিয়ে আর বাবার থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনেছিলাম। আর সেই ফোন টি আমার শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ছিল। টাকার অভাবে কোনো সময় নিজে প্রাইভেট পড়তে পারিনি। অ্যাডমিশনের জন্য কোনো কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হতে পারিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর "বন্দি পাঠশালা " নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ক্লাস করেছি।  আমার মেডিকেলে চান্স পাওয়া পিছনে এই প্ল্যাটফর্মের অবদান ছিল অনেক।

গুরুজনরা বলতো লাইফে বাধা বিপত্তি আসবেই। আমিও ২০২২ সালের শুরুতে বড়ো ধাক্কা খেয়েছিলাম। এক দিন বাবা কাজ শেষ করে বাড়িতে এসে বলে আমার কোমরে ব্যথা করে অনেক। বাবা কোমরে ব্যথা নিয়েও পরের দিন কাজে চলে যায়।  দশ পনেরো দিন কাজ করার পর বাবা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার এক্সরে দিয়ে কিছু ওষুধ দিয়ে দেয়।বাবা  ওষুধে তেমন ভালো ফলাফল পায় না। দুই মাস ভালো থাকে তার পর আবার অসুস্থ হয়ে যায়। এভাবেই চলছে বাবার জীবন। এই দিকে মা ও অসুস্থ। আমার টিউশনির টাকা আর বোন দের কিছু সহযোগিতা নিয়েই চলছে আমাদের সংসার।

680c15ce-0a73-4101-b693-b57712bf4bd7

মা বলছিলো এস এস সি পরীক্ষার পর ভালো কোথাও চান্স হলে পড়বি না হলে ছোট খাটো কোনো কলেজে ভর্তি হয়ে চাকরি তে চলে যাবি। এসএসসি পরীক্ষার শেষে সবাই অ্যাডমিশনের জন্য বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যায়। মা বলত তুই তো কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারবিনা ,তুই বাড়িতে বসেই পড়। কোনো কোচিং ছড়া ঘরে বসেই আমি অ্যাডমিশন এর লেখা পড়া শুরু করলাম। সকলের আশীর্বাদে আমি বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।

মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সৌরভ ডেইলি ক্যাম্পাস কে বলেন, ‘আমি নিজে যেহেতু গরিব পরিবার থেকে উঠে এসে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি, সেহেতু আমি জানি একজন দরিদ্র মানুষ কী অবস্থায় থাকে। যে এটা দেখেনি সে কখনোই বুঝবে না তাদের কষ্টটা কেমন। তাদের কষ্টটা আমি বুঝবো।

আমি যেদিন থেকে ডাক্তার হওয়ার কথা ভেবেছি, সেদিন থেকেই আমি দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবার আশীর্বাদে পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হওয়ার পর আমার গ্রামে একটি চেম্বার করবো। আমি দেশের যেখানেই থাকি না কেন, মাসে একবার হলেও বিনামূল্যে আমার এলাকার মানুষকে চিকিৎসা দেবো।

সৌরভের মা যুথী রানী বলেন, ‘ছেলে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে। আমার ছেলে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এটি মা হিসেবে আমার খুব ভালো লাগার বিষয়।’

সৌরভের বাবা মিন্টু চন্দ্র হাওলাদার বলেন, ‘আমার কোনো আয় বাণিজ্য নাই আমি অচল মানুষ এমতবস্থায় আমার ছেলেকে পড়ালেখা করানো কোনো ভাবেই সম্ভব না। বিধাতা আমার ছেলের মেধা দিয়েছে, সঙ্গে সকলের আশীর্বাদ ও সহযোগিতায় সে এতদূর আসতে পেরেছে। আজ আমার ছেলে মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু ভর্তিসহ পড়ার খরচ চালানোর মতো কিছু নেই আমার। কারো সহায়তা পেলে ছেলেকে মেডিকেলে ভর্তি করাতে পারবো নতুবা সম্ভব নয় ।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence