নারীর সম-অধিকার ছুঁতে পারে না শারমীনদের জীবন
- ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া
- প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৩, ০২:০৪ PM , আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩, ০২:৪৩ PM
রাজধানী মিরপুরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মী শারমিন আক্তার। বিশ্ব যখন নানা আয়োজনে নারী দিবস উদযাপনে ব্যস্ত ২৫ বছর বয়সী এই নারী তখন ব্যস্ত সড়ক পরিচ্ছন্নতায়। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে দ্রুত ঘরে ফিরতে হবে তাকে। সংসার স্বামী-স্ত্রী দুজনের হলেও শারমিনকেই সামলাতে হবে ঘরের সব কাজ। অন্যথায় মিলবে স্বামীর নির্যাতন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে প্রশ্ন করতেই শারমিন বলেন, ‘ওসব বড়লোকগো দিবস। গরীব মাইয়াগো স্বামী ফালায়া না গেলেই খুশি। মারুক-ধরুক তাও স্বামী থাকলে বল থাহে। মানুষজন কথা কইবার পারে না।’
শারমিন জানান, সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন তিনি। এরপর জোর করেই তাকে বিয়ে দেয়া হয়। স্বামী পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। বিয়ের এক বছর পর থেকে স্বামী আর তেমন খোঁজ খবর রাখতেন না। শেষে শারমিন নিজেও ঢাকায় এসে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এরপরেও সুখ ফেরেনি সংসারে। স্বামী প্রায় নিয়মিতই তাকে মারধর করেন। প্রতিবাদ করলেই মেলে দ্বিতীয় বিয়ে ও বিচ্ছেদের হুমকি। ফলে সবকিছু নীরবেই সহ্য করছেন শারমীন।
শুধুশারমিন নন, নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ নারীর জীবনেই সম-অধিকার যেন রূপকথার কোনো গল্প। যেই গল্প তারা মানুষের মুখে-মুখে শোনেন কিন্তু নিজের জীবন বাস্তবতায় এর অস্তিত্ব খুঁজে পান না। এসব নারীদের বক্তব্য অনুযায়ী ভরণপোষণ নিয়ে অনিশ্চয়তা, সন্তানের ভবিষ্যৎ, সমাজে নারীর নিরাপত্তার অভাব এবং মামালার ব্যয় বহনের সামর্থ্য না থাকর কারণেই নীরবে নির্যাতন মেনে নিচ্ছেন তারা।
শারমিনের সাথেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করা নিলুফা নিজের জীবনের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার প্রথম বিয়ের পর সেই স্বামী যৌতুকের জন্য খুব মারধর করতো। শুরুর দিকে টাকা দিলেও এরপর প্রতিবাদ শুরু করি।মামলাও করেছিলাম, চালাতে পারিনি। শেষে বিচ্ছেদ হয়। এরপর ২ বছরের মেয়েকে রেখেই ঢাকা চলে আসি। এখানে এসে দেড় বছরের মাথায় নিজের পছন্দে আবার বিয়ে করি। স্বামী গাড়ির হেল্পারি করতো। কয়েকমাস ভালোই চলছিল কিন্তু এরপর তারও শুরু হয় টাকার চাহিদা আর কথায় কথায় মারধর। সংসারেতো কিছু দিতই না উল্টো আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেশা করতো। দুইবছর যেতে না যেতেই সে আরেকটা বিয়ে করে। ততদিনে এই সংসারেও আমার একটা মেয়ের জন্ম হয়েছে। তাই সব মেনে নিয়েই সংসার করতে হচ্ছে।
নিলুফা আরও বলেন, ‘মাঝে কিছু এনজিওর আপারা আসছিলেন এসব কথা বলতে। কিন্তু প্রতিবাদ করে যাবো কই? স্বামী না থাকলে আশেপাশের মানুষদের থেকে কে বাঁচাবে? আর প্রতিবাদ তো আমি করছিলাম। দ্বিতীয় স্বামীর সংসারেও সেই নির্যাতন সহ্য করেই আছি। এখন বরং এই স্বামী আগের বিয়ে নিয়ে কথা শোনায়, মাঝখান থেকে বড় মেয়েটা না পেল বাবাকে না পেল মাকে।
নারী দিবস নিয়ে গৃহকর্মী ঝুমুর আক্তার বলেন, এই দিবসে নারী পুরুষ সমান এসব নিয়ে কথা হয় জানি কিন্তু আমাদের জীবনেতো আর এসব সম্ভব না। স্বামী ভ্যানে সবজি বিক্রি করে। সারাদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরলে বিশ্রাম নেয়। এখন তার সাথে তুলনা দিয়ে আমিও যদি সব একইরকম করি তাহলেতো আর সংসার চলবে না। অশান্তি হবে। আবার আমার এক মেয়ে আর এক ছেলে। আমি যদি দুইজনের পেছনেই সমান খরচ করি তাহলে কেউই ঠিকঠাক সব পাবে না তাই ছেলেটার পেছনেই বেশি খরচ করি। ও ভালো কিছু করলে দাবি নিয়ে একটা কথা বলতে পারবো কিন্তু মেয়ের বিষয়তো নির্ভর করবে জামাইয়ের ওপর।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক জরিপে দেখা যায়, করোনাকালীন সময়ে ৬৭% শ্রমজীবী নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যাদের মধ্যে ৫৯% নারীই স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত প্রতিবেদনে অনুযায়ী দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন ২ হাজার ৩৬ জন নারী। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হন ৯২ জন। যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয় ৪২ জন নারীকে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৪২৩টি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৪টি। ২০১৯ সালে নির্যাতনে মৃত্যু ৩৬৭ জনের, আর আত্মহত্যা করেন ৯০ জন নারী। ২০২০ সালে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয় ৮৯ জনকে। আত্মহত্যা করেন ১৮ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৭৫ জন নারীকে তাদের স্বামী হত্যা করেন। ৯২টি মামলা হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু বলেন, এখনো মানুষ পারিবারিক সহিংসতাকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করে। সমাজ ও নারীও তা মেনে নেয়। নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য আইনি সাহায্য নেন না।
নারীর অধিকারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘আমাদের দেশে অনেক কিছু নিয়ে যেমন কাজ হচ্ছে আবার অনেক কিছু বাদও থেকে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলো আমাদের আরো কাজ করতে হবে। তবে নিম্নবিত্তদের জন্য বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ বাড়ছে এটি একটি ভালো দিক।
এসময় তিনি আরও বলেন কোনো কিছুর পরিবর্তন করতে গেলে দেখা যায় অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, জটিলতা তৈরি হয়. সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। এসব কারণে অনেকেই প্রতিবাদ না করে বরং পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেন। এছাড়া, আমরা সামাজিক বাধার কারণে নারীর জীবনকে এখনো একটি বড় জায়গায় দেখতে পারি না। নারীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে; সেজন্য সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।