শিক্ষকতায় প্রাথমিকে এগিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পিছিয়ে নারীরা

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পুরুষের তুলনায় নারী শিক্ষক কম
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পুরুষের তুলনায় নারী শিক্ষক কম  © প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে নারীরা। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নারী শিক্ষকের হার কিছুটা বেশি। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ হার অনেক কম। যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুরুষের তুলনায় নারী শিক্ষকেরা অনেক এগিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এ পার্থক্য কমিয়ে আনতে সামাজিক আন্দোলনে জোর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের হার মাত্র ২৯ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক আছেন মাত্র ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার সামান্য বেশি, ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যমতে, ১৯৭৩ সালে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যলয়গুলোয় নারী শিক্ষকের হার ছিল ৮ শতাংশ। বিগত ৫০ বছরে ১৮ শতাংশ বেড়ে ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ হয়েছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নারী শিক্ষকের হার সবচেয়ে বেশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষকই নারী।

এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৯ দশমিক ২৯, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৯ দশমিক ২৭, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ দশমিক ০৭ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনোটিতেই ৭০০ এর বেশি শিক্ষক নেই। দেশের বৃহৎ ও পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষক রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজার ৪২১ জন শিক্ষকের মধ্যে নারী শিক্ষক ৭৫৮ জন। অর্থ্যাৎ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নারী শিক্ষকের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

আরো পড়ুন: নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের ১ ঘণ্টার প্রশিক্ষণও হোঁচট খাচ্ছে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ দশমিক ৬, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ দশমিক ২৭, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ দশমিক ৭৮, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ দশমিক ৭৫, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নারীদের পিছিয়ে থাকার অনেক কারণ রয়েছে। এরমধ্যে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো বেশি দায়ী। এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে উচ্চশিক্ষায় নারীরা এগিয়ে যেতে পারবে না। এ সব সমস্যার সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস)-২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষকের হার কম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম নারী শিক্ষক রয়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের মাত্র ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষক নারী।

এছাড়া পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন। অন্যদিকে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ দশমিক ৮৩, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ দশমিক ৩৮ এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষক নারী। এগুলো হলো, দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, এক্সিম ব্যাংক এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টান ইউনিভার্সিটি, খুলনা এবং ব্রাইটানিয়া ইউনিভার্সিটি। এছাড়া সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটিতে ৫৪ শতাংশ, আশা ইউনিভার্সিটিতে ৫১, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে ৪৮, ফারইস্ট ইসলামীক ইউনিভার্সিটিতে ৪৪, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সে ৪৪, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৯ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন।

আরো পড়ুন: খালি পড়ে আছে শেকৃবির নতুন দুটি হল, শিক্ষার্থীরা গণরুমে

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকতায় নারীদের সংখ্যা কম হলেও প্রাথমিকে এ সংখ্যা অনেক বেশি। বর্তমানে দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন তিন লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জন। এর মধ্যে নারী শিক্ষকের সংখ্যা দুই লাখ ৩১ হাজার ২৮৬ জন। আর পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার ৮০৭ জন। অর্থ্যাৎ প্রাথমিকে নারী শিক্ষকের হার ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫০ বছরে ৫০ শতাংশও জায়গা দখল করতে পারেননি নারীরা। এর কারণ হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ না থাকা, পারিবারিক দায়িত্বে নারীর অংশগ্রহণ বেশি ও শিক্ষক রাজনীতির কথা বলছেন বিশেজ্ঞরা।

তবে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা সংরক্ষণ, নিজ এলাকায় কর্মস্থলের নিশ্চয়তা, পদ সংখ্যা বেশি থাকাসহ রাষ্ট্রীয় কিছু নীতি প্রাথমিকের শিক্ষকতায় নারীদের অংশগ্রহণে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় নারীদের কোটা না থাকা, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, লবিং, দলীয়করণ, নারীবান্ধব নেতৃত্বের অভাবসহ নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় নারীরা সুবিধা করতে পারছেন না বলে জানান শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ ধরনের পার্থক্য কমিয়ে নিয়ে আসতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি বৈষম্য রোধ ও মেয়েদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। অন্যথায় তাঁদের এগিয়ে নেওয়া কঠিন।

আরো পড়ুন: প্রাথমিকের নিয়োগে ৮০ শতাংশই কোটা, ভালো করেও বাদ পড়ছেন অনেকে

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মেয়েদের শিক্ষকতায় পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো তাদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার পর বাবা-মা বিয়ে দিতে চান। এতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না অনেকে। যারা বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যান, তাদেরও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। এর সঙ্গে আবাসনসহ নানা ধরনের সমস্যা তো রয়েছেই।

এর সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, নারী শিক্ষকের এই ঘাটতি পূরণের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা পরীক্ষা বর্জনসহ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেভাবে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মূল আন্দোলনটা শুরু হতে হবে।

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের হলের পাশাপাশি ছাত্রী হলেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। সরকার আরও নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি বাবা-মায়ের তাদের সন্তানের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে শিক্ষকতায় নারীরা আরও এগিয়ে যাবে।


সর্বশেষ সংবাদ