বসন্তে পদ্মার পাড়ে ক্যাডেটদের মিলন মেলা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার  © সংগৃহীত

রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেটদের সংগঠন ‘ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেটস অ্যাসোসিয়েশান’ (অরকা) আয়োজিত ১৪তম পুণর্মিলনী-২০২৫, আগামী ২০-২২ ফ্রেব্রুয়ারি কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের বৈরিতায় এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা নদী এখন মৃতপ্রায়। তবুও এই পদ্মা তীরের মোক্তারপুর গ্রামে বসন্তের পলাশ ফুটেছে। ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলার (চারঘাট উপজেলার) সারদা সংলগ্ন এই মোক্তারপুর গ্রামেই ‘আইয়ুব ক্যাডেট কলেজ’-এর গৌরবময় যাত্রা শুরু করেছিল। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন উইং কমান্ডার এম সাঈদ। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এটিকে ‘রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ’ নামকরণ করা হয়।

ক্যাডেট কলেজের অবদান:
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অসংখ্য মেধাবী তরুণকে জাতি গঠনের সুনিপুণ কারিগর হিসেবে তৈরি করেছে, যাঁরা সামরিক বাহিনীসহ বিভিন্ন পেশায় জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এই মেধাকুঞ্জের মেধাবী ক্যাডেটরা দেশে বিদেশে আলো ছড়াচ্ছেন। ২টি মহিলা ক্যাডেট কলেজসহ বর্তমানে দেশে ১২টি ক্যাডেট কলেজ রয়েছে। এই কলেজগুলো সশস্ত্র বাহিনীর 'ফিডার ইনস্টিটিউশন' হিসেবে মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছে। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজসহ অন্যান্য ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেটবৃন্দ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অঘোষিতভাবে অনেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

স্মৃতির দেশে যাত্রা:
ক্যাডেট কলেজ নিয়ে প্রাক্তন ক্যাডেটদের মাঝে অদ্ভূত এক ধরনের স্মৃতি-কাতরতা কাজ করে। এর কারণ দীর্ঘ ৬ বছর, ৭-১২ ক্লাসের বার্ষিক ছুটির দিনগুলো ছাড়া তাদের সার্বক্ষণিক কলেজেই থাকতে হয়।

প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুল হামিদ এই কলেজের ক্যাডেট নং ১ হওয়ার গৌরবের অধিকারী। তিনি অধ্যাপনা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এই নিবেদিত-প্রাণ প্রাক্তন ক্যাডেটের মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে-বাংলাদেশের মানুষ ও ক্যাডেটদের কল্যাণকামিতায়। রিইউনিয়ন নিয়ে আবেগ ভরে অধ্যাপক আব্দুল হামিদ লিখেন- 'আবার যাব যে ফিরে/তেজস্বী পদ্মার তীরে/ঘন ছায়া মুখতারপুরে/অতীতের নিবিড় নীড়ে'।

পুনর্মিলনী বা রিইউনিয়নের উদাত্ত আহ্বান প্রাক্তন ক্যাডেটদের স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। অযুত স্মৃতি যেন ফোয়ারার পানির মতো ছিটকে বের হতে চায়। কল্পনায় মন চলে যায়... হাউজের সামনে সবুজাভ বাগান, অসংখ্য বটল ব্রাশ বৃক্ষে সুবিন্যস্ত অ্যাকাডেমিক ভবন, দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার, বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ, নদীর উন্মুক্ত বাতাস। শ্রেণিকক্ষে বিশিষ্ট শিক্ষকদের পাঠদানের অভিনবত্বে মুগ্ধতা, ভোরের বিউগল, মাগরিবের মধুর আজানের ধ্বনি, বিকেলের আলোয় পদ্মার ধারে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানোর স্মৃতি। অথবা কৈশোরকালীন নির্দোষ দুষ্টুমির কোনো ঘটনা...।

রিইউনিয়নের কর্মসূচি:
উত্তর বঙ্গের অনন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবারের পূনর্মিলনী কর্মসূচিতে প্রাক্তন ক্যাডেটরা যেন শৈশবের ছাত্রজীবনে আবার ফিরে যাবেন। প্রভাতফেরী, বইমেলা, দেয়াল পত্রিকা, ক্রিকেট খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মৃতি চারণ, রিভার্স অর্ডার, প্যারেড, ফ্যামিলি নাইট, ডিনার, কনসার্ট...। মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম, ক্যারিয়ার কাউন্সিলিংসহ বেশ কিছু কর্মসূচি থাকবে; যা বর্তমান ক্যাডেটদের প্রাক্তন ক্যাডেটদের মাঝে মিথস্ত্রিয়তা তৈরি করবে। 

এবারের পূর্ণমিলনীর থিম হলো ‘কানেকটিং জেনারেশনস’। এইসব অনুষ্ঠানে নবীন ক্যাডেটরা অগ্রজ ক্যাডেটদের থেকে জীবনের অনুপ্রেরণা ও বিবিধ দিক নির্দেশনা পাবে। ক্যাডেট ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে আরো অংশগ্রহণ করবেন কলেজের প্রাক্তন কর্মকর্তা, প্রাক্তন শিক্ষকমণ্ডলী এবং প্রাক্তন ক্যাডেটবৃন্দের পরিবারবর্গ।

আকাশের কয়েকটি উজ্জ্বল তারা:
১৯৭৭ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে সপ্তম শ্রেণিতে যোগ দিয়েছিলাম, আমরা ১৪তম ব্যাচের ৫৪ জন ক্যাডেট। আমাদের যাবতীয় স্বপ্নের জন্মভূমি ছিল এই কলেজ। সেখান থেকেই স্বপ্নের সন্ধানে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম পৃথিবীর পথে। জীবনের দুঃখগুলোকে তুচ্ছ করে দেখে একসাথে কাঁধে কাঁধ রেখে চড়াই-উৎরাই পার হবার মধ্যে আকাশের উজ্জ্বল তারার মতোই হঠাৎ হঠাৎ পথ ছিটকে হারিয়ে গেছে আমাদের ব্যাচের সাতটি জীবন। জীবন চলার পথে আমাদের এ এক বিশাল ট্রাজেডি। 

এবার পদ্মার তীরে সব বন্ধুরা আবার যখন একত্রিত হব, তখন মনে পড়বে তাঁদের কথা। এদের মধ্যে কর্ণেল মো. আফতাবুল ইসলাম (বুলবুল) ও মেজর আহমেদ আজিজুল হাকিম (পলাশ)-কে আমরা হারিয়েছি ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভয়াল বধ্যভূমিতে। আশা করি, আমাদের সবার জীবনের আকাশ যেন সব সময়ই মেঘহীন উজ্জ্বল থাকে। সুখ ও দুঃখের পাশাপাশি অবস্থানে দুঃখগুলো যেন সব সময়ই তুচ্ছ হয় আর সুখের মুহুর্তগুলো যেন ছাড়িয়ে যায় সব ধরনের সীমারেখা।

এখন প্রয়োজন ঐক্য ও সম্প্রীতি:
২০২৪'র জুলাই গণঅভ্যুত্থান বা 'বর্ষা বিপ্লবের' পর বাংলাদেশ নতুন পথে হাঁটছে। এটি কঠিন এক সময়। এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে গত অনেক বছর ধরে আমাদের মাঝে বিভাজন ও দূরত্ব বাড়ছেই।

তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় হলো শৈশব-কৈশোর-তরুণ সময়ের স্মৃতি ঘেরা স্কুল-কলেজের 'অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশান' আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো এইসব বিভাজন ও বিভেদ অতিক্রম করে আমাদের মাঝে অদ্ভূত ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করে থাকে।

গত ২০-২১ ডিসেম্বর ২০২৪, শতবর্ষ উদযাপন করল পাবনা জেলার পাকশীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ’। পদ্মার তীরে অবস্থিত ব্রিটিশ আমলের রেলওয়ে শহরে স্কুলটির শতবর্ষ অনুষ্ঠান প্রাক্তন ছাত্রদের অভূতপূর্ব মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের একজন ছাত্র হিসেবে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে এই বিদ্যালয় ও পাকশী নিয়ে মানুষের আবেগ ও ঐক্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। পাকশী সংলগ্ন ‘বাঘইল স্কুল অ্যান্ড কলেজের’ গৌরবের ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপন হয়ে গেল গত ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। সেখানেও এক অভূতপূর্ব মিলনমেলার স্বাক্ষী হয়ে রইল বাঘইল ও পাকশীবাসী। এইসব ছোট ছোট ঐক্য ও সম্প্রীতির ঘটনা আমাদের বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন দেখায়।

বিপন্ন মানুষের পাশে অরকা:
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অরকা তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েও অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে। সবসময় বিপণ্ণ মানুষের সেবায় তাঁরা এগিয়ে এসেছে। অরকা নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিভিত্তিক কোনো অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশান নয়। বরং এটি একটি সার্বক্ষণিক, আন্তরিকতাময়, প্রাণময় ও জীবন্ত একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে অরকার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবীর তালুকদার (অব.)। অরকা ‘লেট অল অফ আস প্রসপার টুগেদার স্লোগানকে সামনে রেখে বিভিন্ন সেবা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হয়ে সমাজকে প্রতিনিয়ত অগ্রগতির দিকে নিয়ে চলেছে।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকালে পুলিশের গুলিতে এক হাজারের চেয়েও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। চির জীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছে অসংখ্য তরুণ। এই সময় কমপক্ষে ৪০০ তরুণ-যুবকের চোখ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছেন। ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেটস অ্যাসোসিয়েশান (অরকা) ইতোমধ্যে ৩১ জন তরুণের (জুলাই-যোদ্ধা) চোখের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে অরকার ভূমিকা ছিল প্রায় পথিকৃতের মতো। এছাড়াও অরকা গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের বন্যায় ফেনী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণ ও মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করেছে। অরকা বর্তমানে তিনটি অনাথ আশ্রম (অরকা হোমস) ও পরিচালনা করছে।

আশা করি, আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠাতব্য এই পুনর্মিলনী প্রাক্তন ক্যাডেটদের নিজেদের মধ্যে এবং বর্তমান ক্যাডেটদের সঙ্গে প্রাক্তন ক্যাডেটদের মৈত্রী ও সম্প্রীতির সম্পর্ককে আরো সুসংহত করতে সহায়ক হবে। নবীন বসন্তে পদ্মা পাড়ে অরকা আয়োজিত এই মিলন মেলা সাফল্যমণ্ডিত হোক। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের বিভিন্ন প্রজন্ম যুক্ত হোক ঐক্য, ভ্রাতৃত্বের নতুন বন্ধনে। এখন সবাই মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেট।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence