মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে এবার আটক থ্রি ডক্টরস কোচিংয়ের মালিক

পুলিশের হাতে আটক খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. ইউনুস খান তারিম
পুলিশের হাতে আটক খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. ইউনুস খান তারিম  © ফাইল ছবি

মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. ইউনুস খান তারিমকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঢাকার সদস্যরা। শুক্রবার (১৮ আগস্ট) তাকে খুলনা নগরী থেকে আটক করে ঢাকায় আনা হয়েছে। খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুন ডা. তারিমের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগেও সংশ্লিষ্ট অভিযোগে পুলিশের নজরদারিতে ছিল কোচিং প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও ২০১৯ সালেও পুলিশের হাতে আটক হন ডা. ইউনুস খান তারিম।

এর আগে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি সাইবার টিম। তারা মেডিকেল ভর্তি কোচিং ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সেবার আড়ালে প্রশ্নফাঁস করে আসছিলেন বলে জানিয়েছে সিআইডি।

পুলিশ জানিয়েছে, ডা. ইউনুস খান তারিম মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। তিনি তার মালিকানাধীন থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত ১৬ বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন।

প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে—মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজিপি (সিআইডি)।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে জানিয়েছে, খুলনার এই কোচিং সেন্টার ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে ‘মেধাহীন’, ‘অযোগ্য’ ছাত্রছাত্রীদের মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা করে নিচ্ছে। এই ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে বছরে শতকোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসাবে কিছু শিক্ষার্থীর ফলাফল বিবরণীর বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়, যারা থ্রি ডক্টরসে কোচিং করেছেন। তাতে দেখা যায়, তারা কেউ এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পায়নি। তবে ভর্তি পরীক্ষায় ৭৩ করে নম্বর পেয়েছে। একজন ৭৩.২৫ নম্বর পেয়েছে। একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের পড়াশোনা ও জ্ঞান এত নিম্নমানের যে ওই শিক্ষার্থীরা কীভাবে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন, তা বোধগম্য নয়—জানিয়েছে সিআইডি।

আটকের পর অভিযুক্তদের ছবি প্রকাশ করে সিআইডি

সম্প্রতি সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক। তদন্তের ধারাবাহিকতায় খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. তারিমকে আটক করা হয়েছে। এর আগে গত ১৩ আগস্ট সিআইডি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল দেশে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বছরে ১০ বার মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস করেছে একটি চক্র। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তির কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্নফাঁসের কারবার চালিয়ে আসছিলেন।

আরও পড়ুন: ফাঁস হওয়া প্রশ্নে দেড় হাজার ডাক্তার

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বলছে, প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে চক্রটি প্রতি বছর গড়ে ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছে। অর্থাৎ দেশে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে বিগত ১৬ বছরে দেড় হাজার ডাক্তারেরও বেশি চিকিৎসক বের হয়েছেন। যারা বর্তমানে চিকিৎসা সেবার সাথে যুক্ত রয়েছেন। তবে, প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিআইডি।

চক্রের ৮০ জন সক্রিয় সদস্য দেশে বিগত ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোয় ভর্তি করার মাধ্যমে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এরমধ্যে অনেকে পাশ করে ডাক্তারও হয়েছেন—জানিয়েছেন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিগত ২০২০ সালের প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মূল হোতা জসীম উদ্দীন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান জসিমের খালাত ভাই মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করে। আদালতে তাদের দেওয়া ৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এই চক্রের ১২ জনের নাম আসে। দীর্ঘ দিন তারা পলাতক ছিলেন। অবশেষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড ডাক্তার ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান। তিনি ফাইন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। তিনি গত ১৭ বছরে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার স্ত্রী জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডাক্তার সোহেলী জামানও এই চক্রের সদস্য।

এছাড়াও এ চক্রের অন্যতম সদস্য ডাক্তার আবু রায়হান, ডাক্তার জেডএম সালেহীন শোভন, ডা. জোবাইদুর রহমান জনি, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনি, ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল। এছাড়া জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার, রওশন আলী হিমু, আক্তারুজ্জামান তুষার, জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার।

এ ঘটনায় নাম এসেছে মেডিকো ভর্তি কোচিং, ই-হক কোচিং সেন্টার, ফেইম কোচিং, প্রাইভেট কোচিং সেন্টার, থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টার, ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামের একটি ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র এবং প্রাইমেট নামের একটি ভর্তি কোচিংয়ের নাম। সিআইডি জানিয়েছে, মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ের আড়ালে নানা সময়ে এসব প্রশ্ন ফাঁস করেছে চক্রটি।

সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক, প্রবেশপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। 

আরও পড়ুন: মেডিকোর সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত কোচিং অ্যাসোসিয়েশনের

এর আগে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। 

প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।


সর্বশেষ সংবাদ