সরকারের বিরুদ্ধে নয়, অভ্যুত্থান হয়েছে দানবীয় মাফিয়ার বিরুদ্ধে

অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন অনুষদের ডিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) এর যুগ্ম মহাসচিব এবং জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর বা ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা হুমায়ুন রেজা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে। ড. শামীম ১৯৯৭ সালে স্নাতক এবং ১৯৯৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন শেষ করে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধীনে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। শিক্ষা কমিশন-২০০৩-এ গবেষণা সহকারী হিসেবে বেশ প্রশংসিত হন তিনি। জাপানের ওকাইয়ামা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান থেকে ২০১০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল ও পুস্তকে তাঁর ৩৫টির অধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ভেষজ উদ্ভিদ ও মাটির স্ট্রেপটোমাইসিস প্রজাতি থেকে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এবং কীটনাশকের অনুসন্ধান নিয়ে তার দুর্লভ গবেষণা কর্ম রয়েছে। ড. শামীমের রচিত একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ‘কৃষিশিক্ষা’ প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র বই দেশের কলেজগুলোতে পড়ানো হচ্ছে।
তিনি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতীয় দৈনিক কাগজগুলোতে তিনি প্রতি সপ্তাহেই নিয়মিত লেখেন। ইতোমধ্যে তিনি নিজ গ্রামে বিশাল একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেছেন। তাঁর আগ্রহের অন্যতম ক্ষেত্র কৃষিকে ঘিরে হলেও তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ের দেশের রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, জুলাই গণঅভ্যুত্থান, জাতীয় নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে কথা হয় দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের হেড অব নিউজ ইরফান এইচ সায়েমের সাথে। চম্বুক অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো—
আপনার কী মনে হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফসল কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে?
অধ্যাপক ড. শামীম: ধন্যবাদ, দেখুন কোন অভ্যুত্থান কখনো কারো কাছে জিম্মি হয় না, অভ্যুত্থানের শুরু যেমন জন আকাঙ্ক্ষা থেকে তৈরি হয়-অভ্যুত্থান দায়বদ্ধও থাকে জনগণের কাছে। সাময়িকভাবে কেউ কেউ ভিন্নখাতে নিজেদের সুবিধায় অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়কে ব্যবহার করে হয়তো। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে হয়তোবা অভ্যুত্থানের পরবর্তী অবস্থায় সুযোগ নিতে চায়, কিন্তু সেটা পুরো একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। অভ্যুত্থান জিম্মি না এবং জিম্মি হয় নাই এবং কোন দিন হবেও না, ইনশাল্লাহ।
শিক্ষার্থীরা এখন আর পড়ার টেবিলে বসতে চায় না-অভিভাবকদের এমন অভিযোগকে কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. শামীম: যে কোনো অভ্যুত্থান পরবর্তী যে বাস্তবতা তৈরি হয় বা যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হয় তা খুব স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। আমরা যদি সারা পৃথিবীতে বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থান পরবর্তী অবস্থা দেখি, তাহলে দেখবো, এ ধরনের বড় বড় অভ্যুত্থানের পরে-পাল্টা অভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি, একটা অস্থির অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একটি জাতিকে। সে অবস্থায় অনেকেরই গতানুগতিক কাজের ব্যাঘাত ঘটে বা গতানুগতিক যে কার্যক্রমের ধারা তা ব্যাহত হয় -সেটা ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীরাও তার বাইরে নয়।
কিন্তু এ কথা একেবারেই পুরোপুরি ঠিক না যে, শিক্ষার্থীরা এখন আর পড়ার টেবিলে বসতে চায় না। একটি ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারী অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে- এমন আনন্দিত অবস্থায় অনেকেরই অনেক কাজে মন বসে না, এতে একেবারে শিক্ষার্থীদের উপর একতরফা দোষ চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী আমি না।
শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরো মনোযোগী হবে, এখনো মনোযোগী আছে। আমরা ইতিমধ্যে অনেক ভালো ভালো খবর পেয়েছি, অনেক ছাত্র-ছাত্রী অনেক ভালো রেজাল্ট করছে। অনেকে দেশ-বিদেশে অনেক ভালো কিছু করছে। অতএব পড়ার টেবিলে বসতে চায় না এটা সাময়িক একটা সমস্যা। এটা একেবারেই অভ্যুত্থানের কুফল বা অভ্যুত্থানের অবস্থা বলে চালিয়ে দেওয়ার সাথে আমি একমত না। এটা সাময়িক একটা অবস্থা, এটা ঠিক হয়ে যাবে।

জুলাই সনদ প্রকাশে বারবার বিলম্বের কারণ কী? এ দুর্বলতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন আপনি?
অধ্যাপক ড. শামীম: দেখেন, জুলাই সনদ কোনো হালকা বা কোনো ঝাপসা বস্তু না। দেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষ, প্রতিটি নাগরিক, অভ্যুত্থানের প্রতিটি অংশ এবং অভ্যুত্থানের যারা অংশীদার সবার সাথে আলাপ আলোচনা করেই জুলাই সনদ দিতে হবে বা দেওয়া উচিত। এটি এমন একটি অভ্যুত্থান- যা একটি বিশাল সময় ধরে অপশাসন, দু:শাসন, নির্বাচনহীনতা, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জনবিস্ফোরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের একটি রক্তাক্ত সমাপ্তি।
আমাদের বুঝতে হবে, আপনি যখন সনদ তৈরি করবেন আপনি এক ধরনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করলেন, তাই সবগুলো অংশীদার এবং অংশীজন নিয়ে আপনি সনদের ঘোষণা দিবেন- এটি খুব সহজ না এবং দু চার দিনের কাজও না। আপনি বুঝতেই পারছেন অনেকেরই সদিচ্ছা আছে বা সব অংশই জুলাই সনদের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে, কারো কারো দু একটি জায়গায় দ্বিমত থাকতে পারে সেখানে ঐক্যমত আসার চেষ্টা করা হচ্ছে- যেহেতু সবার মতামত কে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে তাই সময় নিচ্ছে। আমরা আশা করি, জুলাই সনদ প্রকাশিত হবে ও তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অংশীদারিত্ব খুঁজে পাবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন, এর পেছনে অন্য কারণ ছিল কী?
অধ্যাপক ড. শামীম: বিগত শাসনের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই শাসন ব্যবস্থাকে আমি সরাসরি কোন সরকার বলতে পারছি না। তাই আন্দোলনটাকেও সরাসরি সরকার পতনের আন্দোলনও বলা যাচ্ছে না। আমি বরং বলি, এটি একটি দানবীয় মাফিয়া শাসন ব্যবস্থা ছিল। একটি মাফিয়া ব্যবস্থা তৈরি করে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর একটি জবরদস্তি শাসন চলছিল। জাতির আন্দোলন বা অভ্যুত্থান হয়েছে এই মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং স্বৈরশাসনের পতনের জন্য।
প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে সবাই শুধু দিন গুনছিল যে, এই অবস্থা থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। আসলে পতন তো অনিবার্য ছিল সেটা এতগুলো নিরীহ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী আর মেধাবী শিক্ষার্থীদের জীবনের বিনিময়ে হবে সেটা হয়তো আমরা বুঝতে পারেনি। দুর্নীতি, দুঃশাসন আর গুম খুনের মাত্রা ছাড়িয়ে এতগুলো মানুষের লাশের উপরে দাঁড়িয়েও এইভাবে ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চাইবে সেটা হয়তোবা আমরা বুঝতে পারিনি।
গণঅভূত্থ্যানে জুলাই-আগস্টের দিনগুলো কীভাবে কেটেছে আপনার?
অধ্যাপক ড. শামীম: দেখুন, আমি একজন শিক্ষক। পিতা মাতার সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক, শিক্ষকের সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কটা ঠিক তেমনি। একজন ছাত্র যখন সন্ত্রাসী দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয় তখন আসলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, আমরা হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারিনা।
যদিও গত দুঃশাসন, অপশাসন, আর ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সব সময় আমরা লেখালেখি করেছি, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন, ব্যানার- ফেস্টুনে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি, শিক্ষক হিসেবে একটি দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করার জন্য আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই অভ্যুত্থানে ছাত্রদের তাজা রক্ত দেখে আমরা কেউই আর ঘরে থাকতে পারিনি- সবাই রাস্তায় বের হয়েছি, প্রতিবাদ করেছি, যেভাবে পেরেছি পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। বেঁচে আছি এজন্য মহান আল্লাহ পাকের কাছে অশেষ শুকরিয়া।

জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা এ দেশে বাস্তবায়ন কী সম্ভব, আপনি কি মনে করেন?
অধ্যাপক ড. শামীম: কোনো অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষা আপনি এক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি পৌঁছাতে পারবেন না। পরিপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষা পেতে একটি বিশদ পরিকল্পনা এবং সর্বজনীন অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তার জন্য আপনার দরকার একটি গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত, মানুষের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি সরকার ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থা সংসদে আইন প্রণয়ন করতে পারবে, আইনের প্রয়োগ করতে পারবে, আইনি ব্যবস্থায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে আইনের সংশোধন করতে পারবে এমন একটি ব্যবস্থা।
সরকার তার চেষ্টা করছে কিন্তু মনে রাখতে হবে এটি একটি অভ্যুত্থান পরবর্তী অবস্থা তাই পরিপূর্ণতা খুব সহজেই পেয়ে যাবো তা না, সময় লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলো চেষ্টা করছে, সরকার চেষ্টা করছে, দেখি কত তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারি আমরা!!
জুলাইয়ে যে রাজনৈতিক ঐক্য এবং সামাজিক সংহতি দেখা গিয়েছিল তা এখন অনেকটাই ম্লান। কেন হলো এমন পরিস্থিতি?
অধ্যাপক ড. শামীম: ধন্যবাদ, পৃথিবীতে সব সম্পর্কেরই ওঠানামা হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক বিষয়। সব রাজনৈতিক দল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আলাদা আদর্শ আছে, আলাদা ভিত্তি আছে, আলাদা গঠনতন্ত্র আছে, আলাদা রাজনৈতিক কাঠামো আছে -এসব কিছুর উপর ভিত্তি করে কিছুটা মতপার্থক্য হতেই পারে। কিন্তু বৃহত্তর বাংলাদেশের স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে আমি এখনো মনে করি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশ থেকে ভারতে পলায়ন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ থেকে কি শিক্ষা নেবে?
অধ্যাপক ড. শামীম: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি করার জন্য ধন্যবাদ। রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা তো সুস্পষ্ট। অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী, আর স্বৈরাচারী ব্যবস্থা- এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভব।
জনগণকে সম্মান করে, নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষা এবং কাঠামো তৈরি করা উচিত। জনগণের অধিকারকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বা জনগণকে অসম্মান করে কেউ এই দেশে ক্ষমতায় থাকতে পারবেনা এটি সুস্পষ্ট।
আগামীর রাজনীতি ও সমাজে চিত্র কেমন দেখছেন?
অধ্যাপক ড. শামীম: আমি আশাবাদী। আমি মনে করি, গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ফিরে আসবে এবং তা খুব শীঘ্রই আসবে। একটি উদার, সাম্য ও ন্যায়ের বাংলাদেশের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। একটি গণতান্ত্রিক, কল্যাণমুখী এবং উদার রাজনৈতিক বাংলাদেশের চিত্র শিগগির দেখবো বলে বিশ্বাস করি।

এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাবের আপনি একজন নেতা। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর আলোচনা এক সময় বেশ জোরেশোরে চলছিল। এখন এ দাবি তেমন শোনা যায় না। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা কী এখনও আছে?
অধ্যাপক ড. শামীম: ধন্যবাদ আপনাকে বিষয়টি তোলার জন্য। শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির মেরুদন্ড। আপনি পৃথিবীর এমন কোনো দেশ পাবেন না যারা শিক্ষাকে অবহেলা করে উন্নতি করেছে। বরং উল্টোটা হয়- আপনি যদি সারা পৃথিবীর দিকে তাকান তবে দেখবেন; যে জাতি বা দেশ যত বেশি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে তারা তত তাড়াতাড়ি উন্নয়ন করেছে এবং তত তাড়াতাড়ি সব খাতে তাদের সফলতা দেখাতে পেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবশ্যই এখনো তাদের দাবির ব্যাপারে সচেতন এবং এটা তাদের প্রাপ্য।
আপনি দেখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হুটহাট করে কিন্তু কোন আন্দোলন করে জন-মানুষের বা রাষ্ট্রের ভোগান্তি করতে চায় না। আমরা সব সময় যৌক্তিক, সময়োপযোগী দাবি করি। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার একটি বিষয়- কারণ শিক্ষা এবং শিক্ষকদের গুরুত্ব দিলে আপনি জাতি গঠনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তাদেরকে আরো বেশি আগ্রহী করতে পারবেন। আমরা চাই সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবে, তবে আমরা কারো ভোগান্তি চাই না।
আপনি জানেন এটি একটি অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার (একটি বেতন কাঠামো তৈরি করতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে আইন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন ধরনের আইন ও ধারার পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে, সংশোধন এবং সংযোজনেরও দরকার আছে)। তাই আমরা নির্বাচিত সরকারের কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিষয়টি উপস্থাপন করবো এবং বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে তা আদায় করব... ইনশাল্লাহ।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে অটোপাস বা শর্ট সিলেবাসের দাবি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আবার, বিগত ১৫ বছরে উচ্চশিক্ষার যাচ্ছেতাই অবস্থা। ফলে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতাসহ যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে না। এতে দেশে উৎপাদনশীলতা কমেছে ও ভবিষ্যতে আরও কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি ক্যাম্পাস ও জাতীয় জীবনে অনুভূত হলেও এর সংস্কারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন?
অধ্যাপক ড. শামীম: আসলে অটোপাশ, শর্ট সিলেবাস বিষয়টি আমাদের সামনে আসে গত করোনার সময়। এসএসসি এবং এইচএসসির ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পায়। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অটোপাশ খুব একটি সাধারণ বিষয় বলে আমার মনে হয় না। কোনো ন্যায্য কারণ ছাড়া অটোপাশকে একদমই প্রাধান্য দেওয়া ঠিক না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিবে। অভ্যুত্থানের সময় যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আন্দোলনের অন্যতম অংশ ছিল- তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে হয়তো একটু সময় লাগবে কিন্তু অনেকাংশেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আর বিগত ফ্যাসিস্ট সময়ে আমাদের প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা সর্বত্রয় যে দৈন্য দু:র্দশা সৃষ্টি হয়েছিল তা জাতির কাছে একটি অন্ধকার ভয়াল কালো অধ্যায় বটে।

জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর বা ট্রেজারার আপনি। সম্প্রতি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল দাবি তুলছে। গণঅভূত্থ্যান পরবর্তী বাংলাদেশে পিআর দাবি কতটুকু যৌক্তিক বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ড: শামীম: বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক একটি রাষ্ট্রের গত কয়েক দশকে অনেক রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সবকিছুর শেষেও দেশে একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা ছিল ''তত্ত্বাবধায়ক সরকার"। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ফসল। তারপরে ফ্যাসিস্ট এসে সেটাকে অসাংবিধানিকভাবে হত্যা করলো এবং মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিলো। পিআর একটি নতুন আলোচনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পিআর চলমান। তবে, এর কয়েকটি ধাপ আছে এবং পিআরের কয়েকটি মেথডও আছে। আপনি পিআরের কোন মেথড ফলো করবেন তার জন্য আলোচনা, আইন প্রণয়ন, নীতি প্রণয়ন, ধারার বাস্তবায়নসহ অনেক কিছু প্রয়োজন। পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করতে হবে, আইন প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণ লাগবে, আমি বলছি না পিআর খারাপ বা পিআর ভালো। পৃথিবীর অন্যতম গণতন্ত্রের সব দেশে এখনো পিআর নাই। আমাদের অনেক কিছু ভাবতে হবে- তবে একটি নির্বাচিত ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সরকার তৈরি হলে, সেই সরকার সব রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এ বিষয়টির উপর আইন হবে, সংসদের বিল উপস্থাপন হবে, পরিকল্পনা হবে এবং জনগণের কী ধরনের অংশগ্রহণ হবে তা নিয়ে বিশদ আলাপ আলোচনার প্রয়োজন আছে।

দেখুন, পিআরের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো- আপনি চরমপন্থীদেরও কিন্তু একটি সুযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন এই ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে। আমি বলছি না যে, এর মাধ্যমে চরমপন্থা চলে আসবে কিন্তু আমি বলছি সুযোগ থাকে। আবার এর অনেক সুবিধাও আছে। অতএব এগুলো বিশদ আলোচনার বিষয়।
বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা কতটা আশাজাগানীয়া হবে সে বিষয়ে ডায়ালগ, আলাপ-আলোচনা করতে হবে, সংসদে আইন পাস করতে হবে, এটা সময় সাপেক্ষ। যদি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত পোষণ করে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়, জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয় তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। তবে আমার মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করে, বর্তমান অবস্থার কথা চিন্তা করে, সময় নিয়ে- যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উত্তম যেটা সবার জন্য মঙ্গল হবে।
সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. শামীম: আপনাকেও ধন্যবাদ।