যেদিন দেখলাম বন্ধু জজ হয়েছেন, সেদিন থেকেই আমার জীবন বদলানো শুরু

এম. এ. উমায়ের
এম. এ. উমায়ের  © টিডিসি

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ১৭তম (বিজেএস) নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন এম. এ. উমায়ের। আইনের প্রতি ভালোবাসা থেকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালিয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও আইন না পাওয়ায় ভর্তি হয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি তার সাফল্য ও শিক্ষা জীবন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো— 

১৭তম বিজেএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। আপনার জন্ম, শৈশবকাল সম্পর্কে জানতে চাই। 

এম. এ. উমায়ের: আমি ঠাকুরগাঁওয়ে জন্মেছি। সেখানেই মায়ের আদরে বেড়ে ওঠা।  ঠাকুরগাঁও জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। বাসার পাশে শুক নদে সাঁতার, বন্ধুবান্ধবের সাথে সামাজিক কর্মকাণ্ড, সংগঠন গড়ে তোলা এসবেই আমার কৈশোর কেটে যায়। আইনের প্রতি ভালবাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও আইন না পাওয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে  ভর্তি হই।

করোনা মহামারি  আমাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। যেদিন দেখলাম ১৬তম জুডিশিয়ারির রেজাল্ট দিয়েছে এবং আমার বন্ধু প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই জজ হয়ে গিয়েছেন। অথচ, আমি কী করছি! ছন্নছাড়া এক ভবঘুরে জীবন কাটাচ্ছি। সেদিন থেকে জীবন বদলানোর গল্প শুরু। 

এখন তো আপনি একজন সুপারিশপ্রাপ্ত সহকারী জজ। আপনার প্রস্তুতির শুরুটা কেমন ছিল? কবে থেকে নিয়মিত পড়াশোনা শুরু করেছিলেন?

এম. এ. উমায়ের: আমার শুরুটা মোটেই সুখকর ছিল না। ভার্সিটি লাইফে প্রচুর ঘুরেছি, আড্ডাবাজি করেছি, খেলাধুলা করেছি- এভাবেই দিন কেটেছে। করোনা মহামারি  আমাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। ডিপার্টমেন্টে বেশ কয়েকজন বন্ধুর সহায়তা নিয়ে স্নাতকে ফার্স্ট ক্লাস তুলতে পারি। জুডিশিয়ারির পড়ালেখা শুরু করি ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে, যেদিন দেখলাম ১৬তম জুডিশিয়ারির রেজাল্ট দিয়েছে এবং আমার বন্ধু প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই জজ হয়ে গিয়েছেন। অথচ, আমি কী করছি! ছন্নছাড়া এক ভবঘুরে জীবন কাটাচ্ছি। সেদিন থেকে জীবন বদলানোর গল্প শুরু। নিয়মিত পড়ালেখা শুরু করি। প্রয়োজনীয় বই কেনা, নোট সংগ্রহ করা, জজ বন্ধুদের সাহায্য নেওয়া—এসবই তখনকার রোজনামচা বলা চলে।    

প্রতিদিন গড়ে কত ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন এবং কোন পদ্ধতিতে প্রস্তুতি নিতেন?

এম. এ. উমায়ের: প্রতিদিন কত ঘণ্টা করে পড়াশোনা করেছি, তার চেয়ে আমার কাছে তখন জরুরি ছিল কোয়ালিটি টাইম কতক্ষণ দিতে পারছি সেটা। প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে টানা ৬ মাস পড়েছি।, আর পদ্ধতির কথা বলতে আমি প্রশ্ন-বিশ্লেষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। ১০ ঘণ্টা মধ্যে ২ ঘণ্টা বিগত বিজেএস ও বারের প্রশ্নব্যাংক বুঝার চেষ্টা করেছি, ৩ ঘণ্টা নোট করেছি, ৪/৫ ঘণ্টা পড়েছি।

ঈদ-উল-ফিতরের ২০ দিন পরে প্রিলি পরীক্ষা ছিল; এ জন্য ঈদে বাড়ি যাইনি, মেসেই থেকেছি। ঢাকার বন্ধুবান্ধবও কেউ দাওয়াত দেয়নি। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। একা একা লাগছিল, মনে হচ্ছিল এই যান্ত্রিক শহরে প্রিয় মানুষ থাকা কতটা জরুরি! 

লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিতে কী ধরনের পার্থক্য ছিল?

এম. এ. উমায়ের: লিখিত ও ভাইবার প্রস্তুতিতে পার্থক্য রয়েছে। তবে দুই ক্ষেত্রেই আইন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।  জেনারেল সাবজেক্ট আপনাকে প্রিলি টিকতে সহায়তা করবে কিন্তু, আইন আপনাকে জজ বানাবে। লিখিত পরীক্ষার ১০০০ এর মধ্যে আইনের ৬০০ নম্বর বেশ প্রভাব ফেলে। এখানে ৬০০ এর মধ্যে ৪০০ এবং জেনারেলে (বাংলা, ইংরেজি, ম্যাথ, সাধারণ জ্ঞান) ৪০০ এর মধ্যে ২০০ নিশ্চিত করতে পারলে আপনি একজন জজ হবার জন্য ভাইভা বোর্ডে হট ক্যান্ডিডেট। আমি এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে প্রস্তুতি নিয়েছি। 

প্রস্তুতির সময় কীভাবে মানসিক চাপ সামলেছেন এবং মোটিভেশন ধরে রেখেছেন? কখনও পিছু হটতে ইচ্ছে করেনি?

এম. এ. উমায়ের: মানসিক চাপ বরাবরই ছিল। এসএসসি ও এইএসসি উভয় পরীক্ষায় আমি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছি। তাই, বাবা-মায়ের এক্সপেক্টেশন বেশি ছিল আমার প্রতি। মাঝখানে নিউরোলজিকাল সমস্যায় ভুগেছি। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি। আমার অবস্থা থেকে মা  বলতো, এত পড়িস না। চাকরি ২/৩ বছর পরে পেলেও চলবে।  কিন্তু আমি জেদি ছিলাম, কষ্ট করলে এক বছরই করবো। টেবিলে পড়তে গিয়ে ঘাড় ব্যথা হলে বেডে শুয়ে শুয়ে পড়েছি, তপ্ত গরমের দিনে ঢাকার মেসের ছাদে লাইট লাগিয়ে রাত ৩/৪ টা পর্যন্ত পড়েছি। কারণ, আইনের বেসিক আমার খুব দুর্বল ছিল।

পিছু হটার কথাও চিন্তা করেছিলাম। যখন টানা ৩ টা অর্থোপেডিক্স ডাক্তার দেখানোর পরেও ঘাড় ব্যথা কমছিল না, তখন মনে হয়েছে বাড়ি ফিরে যাই, বছর খানেক থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসি।

সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার পুরো যাত্রায় তিক্ত/মধুর কোনো স্মৃতি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে? 

এম. এ. উমায়ের: তেমন কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। একটু মন খারাপের গল্প আরকি। ঈদ-উল-ফিতরের ২০ দিন পরে প্রিলি পরীক্ষা ছিল; এ জন্য ঈদে বাড়ি যাইনি, মেসেই থেকেছি। ঢাকার বন্ধুবান্ধবও কেউ দাওয়াত দেয়নি। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। একা একা লাগছিল, মনে হচ্ছিল এই যান্ত্রিক শহরে প্রিয় মানুষ থাকা কতটা জরুরি! 

আর মধুর স্মৃতি বলতে অনেক কিছুই আছে। আমাদের টানা ১০ দিন লিখিত পরীক্ষা হয়। একদিন পরীক্ষা থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেছি, ভিকারুননিসা স্কুলে বাইরের ফুটপাতে বসে ৩০০/৪০০ জন মানুষ পরীক্ষার আগে ঘণ্টাখানেক একই বিষয় পড়া, সত্যিই এ সবই এখন মধুর স্মৃতি হিসেবে মনে উঁকি দিচ্ছে।

যারা আমার মতো অনার্সে তেমন পড়েননি, স্বল্পসময়ে স্বপ্নের চাকরিটি পেতে চাচ্ছেন; প্লিজ টানা ৬-৯ মাস প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে লেগে থাকুন। শেষ হাসি আপনি পকেটে নিয়েই বাসায় ফিরবেন।

ভবিষ্যতে যারা সহকারী জজ হতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

এম. এ. উমায়ের: যারা অনার্স পড়াকালীন বিজেএস প্রস্তুতি নিতে চাচ্ছেন, তাদের বলবো চাপ নেবেন না। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখুন। একটু একটু করে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করুন। অন্যদিকে, যারা আমার মতো অনার্সে তেমন পড়েননি, স্বল্পসময়ে স্বপ্নের চাকরিটি পেতে চাচ্ছেন; প্লিজ টানা ৬-৯ মাস প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে লেগে থাকুন। শেষ হাসি আপনি পকেটে নিয়েই বাসায় ফিরবেন। আর যারা ৪/৫ বার প্রিলি, রিটেন, ভাইভা দিয়েও সফল হতে পারছেন না, তাদের আমি সান্ত্বনা ছাড়া আর কি বা দিতে পারি। আমি তো সেই সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে যাইনি, তাই কোনো পরামর্শ দিতে পারছি না। এতটুকু বলবো আপনারা ধৈর্য ধরে এগিয়ে যান, সৃষ্টিকর্তা হয়তো আরো ভাল কিছু চিন্তা করেছেন আপনাদের জন্য। শেষ কথা বলতে, পড়ালেখার প্রতি সৎ থাকুন ও কৌশল সাজান, কারণ এটা কখনো আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

এম. এ. উমায়ের: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভকামনা রইলো। 


সর্বশেষ সংবাদ