শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে, অপরাজনীতি করবে না: চবি উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫৮ বছরে পদার্পণ করেছে আজ শনিবার (১৮ নভেম্বর)। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। গত ৪ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর পূর্ণ হয়েছে তার। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে চবি। প্রতিকূলতা পেরিয়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, সে অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিশ্ববিদ্যালয় দিবস নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন ড. শিরীণ আখতার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজ কনট্রিবিউটর শেখ আব্দুল্লাহ্ ইয়াছিন।
টিডিসি: আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
ড. শিরীণ আখতার: ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো। তুমি?
টিডিসি: ভালো। আপনার উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর পূর্ণ হলো। এ সময় আপনি কোন দিকটিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন? সফল হয়েছেন বলে মনে করেন?
ড. শিরীণ আখতার: দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি প্রথমে দৃষ্টি দিয়েছি কীভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন করতে পারি সেদিকে। আমি আসার আগে বায়োলজির শিক্ষার্থীরা শুধু জাপানের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর সোস্যাল সায়েন্স, আর্টসের শিক্ষার্থীরাও এতে সুযোগ পাচ্ছে। আমি জাপানে গিয়েছিলাম। সেখানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার এমওইউ হয়। আমাদের শিক্ষার্থীরা ওখানে স্কলারশিপে পড়তে যেতে পারবে।
তাদের ওখান থেকেও দুই মাস আগে ১৩ জন স্টুডেন্ট আমাদের এখান থেকে ক্লাস করে ঘুরে গেছে। জেনে খুশি হবে, এ বছর আমাদের এখান থেকে ২৫ জন শিক্ষক ইউএসএ, কানাডা, ইউরোপ, জাপানসহ নানান দেশে স্কলারশিপ নিয়ে গেছে। আমরা শিক্ষার্থীদের জন্যেও চেষ্টা করছি। আমাদের জাপান ছাড়াও মালদ্বীপের সাথে এমওইউ হয়েছে। মালদ্বীপের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ল’ এর ক্লাস করছে।
এছাড়া আমরা ব্লু ইকোনমিকস সেন্টার করতে কক্সবাজারের শীতকালিতে প্রায় আট একর জায়গা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু করতে হলে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে অনুমতি নিতে হয়। এটা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির অপেক্ষায় আছে। আমরা এর অনুমতি দ্রুত পেয়ে যাব আশা করছি। বঙ্গবন্ধু ব্লু ইকোনমিকস সেন্টার হয়ে গেলে এখানে নানান ধরনের গবেষণা হবে। আর আমাদের ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউজের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন হয়ে গেছে। এটার কাজ চলমান আছে।
বিদেশ থেকে কিছুদিন আগে একজন অতিথি এসেছেন। তিনি এসে আমাদের গেস্ট হাউজে থাকছেন, ক্লাস নিচ্ছেন। আমরা এ বছর বা তার পরের বছর র্যাকিংয়ে যেতে চাই। আমরা র্যাংকিং এর জন্য একটা কমিটি করে দিয়েছি। যে কমিটি আমাদের ছাত্র-শিক্ষকরা কীভাবে গবেষণা করছে, কতজন ছাত্র-শিক্ষক এ পর্যন্ত গবেষণা করছে, সেসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে।
শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যা নিরসনে বঙ্গবন্ধু হল, অতীশ দীপংকর হল ও মেয়েদের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল শিক্ষার্থীদের জন্য চালুর ব্যবস্থা করেছি।
টিডিসি: গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ বেড়েছে?
ড. শিরীণ আখতার: আমাদের গবেষণায় বরাদ্দ বেড়েছে। আমরা গবেষণা খাতে ৬ কোটি থেকে ৯ কোটি টাকায় উন্নীত করেছি। এছাড়া কেউ যদি গবেষণা করতে চান এবং পেপার সাবমিট করেন, তবে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা একসঙ্গে পেয়ে যান। এছাড়া আমাদের শিক্ষকরা যেসব গবেষণার প্রজেক্ট পাচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যেটা আগে ছিলো না।
আর আমাদের শিক্ষকদের গবেষণা থেমে নেই। এরইমধ্যে তারা গবেষণার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। কোভিডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে জিনোম সিকোয়েন্সের এমন ভেরিয়েন্ট তারা বের করেছেন, যেটার আফ্রিকা এবং ইন্ডিয়ার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। ২১টি জিনোম সিকোয়েন্স তারা বের করেছেন।
টিডিসি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটলের বগি সমস্যা দীর্ঘদিনের। এ সমস্যা নিরসনে কী ভাবছেন?
ড. শিরীণ আখতার: রেলমন্ত্রী চট্টগ্রামে এসেছিলেন। আমি রেলমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি বলেছিলেন আমাদের নতুন ট্রেন দেবেন। কিন্তু দিলেন না। তিনি বললেন, আপনারা তো আর যোগাযোগ করেননি। আসলে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের আগের কমিটিতে একটু পরিবর্তন আসায় সেটা আর করা হয়নি।
গত ১২ নভেম্বর সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেল স্টেশনের যাত্রী সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ ও এক্সেস কন্ট্রোল নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। তখন তাকে আমরা শাটলের সমস্যার কথা জানাই। উনি বললেন, উনাকে একটা দরখাস্ত দিতে।
তিনি সেটা পৌঁছে দেবেন। আমরা দিয়েছি। আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, সামনে কোনো একটি প্রকল্পে তা যুক্ত করে আমাদের নতুন ট্রেন দেবেন। আমরা শুধু একটি ট্রেনই চাইনি, এতে যাতে পাওয়ার কার থাকে, লাইট ফ্যান, ওয়াশরুম থাকে,উ ন্নত মানের বগি থাকে- তাও চেয়েছি।
টিডিসি: আধুনিক সময়ে এসেও শিক্ষার্থীদের ব্যাংকে লাইন ধরে টাকা জমা দিতে হয়, এ ভোগান্তির শেষ কোথায়?
ড. শিরীণ আখতার: স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মার্ট করতে অটোমেশনের আওতায় আনতে কাজ করছি। আমরা এ বিষয়ে প্রস্তাব মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচন, তাই হয়তো সময় লাগবে। বছর কয়েকের মধ্যে আমাদের একটা বড় ধরনের পরিবর্তন চলে আসবে। তখন আমাদের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিও কমবে।
আরো পড়ুন: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৫৮ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
টিডিসি: বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য আসন বরাদ্দ থাকলেও বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন না। এর কারণ কী মনে করেন? বাইরে থেকে শিক্ষার্থী আনতে আপনারা কোনো পদক্ষেপ কি নিয়েছেন?
ড. শিরীণ আখতার: বিদেশি শিক্ষার্থী না আসার কিছু কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে প্রধান কারণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীর বাইরে। ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীরা কম আসতে চায়। তবে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে আমরা চার সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছি। বিদেশি স্টুডেন্টদের জন্য গেস্ট হাউজ দরকার। ক্যাম্পাস ক্লাবের পাশে সেটার কাজ চলছে। ভর্তির বিষয়ে প্রচারণা চলছে। এবার সিন্ডিকেটে ইন্টান্যাশনাল একটা অফিস করার বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটা অনুমোদন হলে আমরা নানা এডুকেশনাল এফেয়ার্স করবো।
টিডিসি: ৫৮ বছরে চবিতে মোট সমাবর্তন হয়েছে চারটি। আপনি দায়িত্ব গ্রহণে পর একাধিকবার সমাবর্তনের কথা বললেও তা হয়নি। সমাবর্তনে বাধা কোথায়?
ড. শিরীণ আখতার: প্রথম দুবছর আমাদের বলা হয়েছিল সমাবর্তন হবে। সমাবর্তন হওয়ার জন্য প্রস্তাবটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সবুজ খাতায় উঠে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হয়। এটা প্রথমে আমাদের জানা ছিল না। পরের বছর আমাদের সিন্ডিকেট সদস্য সম্পদ বড়ুয়া এ বিষয়ে অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি উপাচার্য হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করলেও এর মধ্যেই করোনা চলে আসে।
এ সময় রাষ্ট্রপতি কোথাও বের হবেন না জানিয়েছেন। আমি দেখলাম আমাদের আবেদনটা আসলে আটকে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কেন আটকে থাকে, সেটা বুঝতে পারলাম না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের সমাবর্তনের প্রস্তাবটি সবুজ খাতায় ওঠেনি। এটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নাকি কারও গাফিলতি জানি না। তখন রাষ্ট্রপতির মেয়াদ বাকি ছিল আট মাস।
সিন্ডিকেট সদস্য সম্পদ বড়ুয়া আমাদের জানালেন, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অসুস্থ, তাই এখন সমাবর্তনের জন্য পাব না। তাই সে সময় হয়নি। এখন আমরা বিষয়টি সমাধান করেছি। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের সময় দেবেন। আমরা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সমাবর্তন করতে পারব আশা করি।
টিডিসি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ড. শিরীণ আখতার: আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেক সূদুরপ্রসারী। জানি না আমি করতে পারব কিনা। তবে, আমি কিন্তু স্বপ্ন দেখি। খুব স্বপ্নীল মানুষ তো। করোনা না হলে আমার অনেকগুলো কাজ হয়ে যেত। চীনের সঙ্গে আমাদের এমওইউ হয়েছে। তারা ১১ তলা একটা কনফুসিয়াস সেন্টার করে দেবে। যদিও সেন্টারের অবকাঠামোর কাজ শুরু হয়নি। তবে অনলাইনে ক্লাস চলছে।
যদি আমাদের সেন্টারটা হয়ে যায়, আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাষা শিখে চীনে যেতে পারবে। আর আমাদের আইএমএল কনফুসিয়াস সেন্টারের অধীনে চলে আসবে। শিক্ষার্থীরা যাতে স্কিল ডেভলাপ করতে পারে আমি সেটা ভাবছি। আমরা ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গেও এমওইউ করেছি। তারা আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাবে। আমার আরও স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন বলব না, সত্যিকার রূপান্তরিত হওয়ার পথে আছে।
আমাদের যে ঝরনাটা আছে, এতে প্রায়ই মানুষ মারা যায়। চীনের যেমন হোয়াংহো দুঃখ, আমাদের তেমন ঝরনাটা দুঃখ। এটাকে শাসন করে এখানকার পানি দিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করব। স্বপ্ন এমন অনেক আছে। জানি না, কতটুকু করতে পারি। না পারলেও শুরু করে দিয়ে যাব।
টিডিসি: বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ঘিরে কি কি আয়োজন থাকছে?
ড. শিরীণ আখতার: এ দিনটি বছরে একবার আসে। দিনটি আগ্রহের সহিত আমরা পালন করি। আমরা সারা বছর বসে থাকি দিনটির জন্য। আগে আমরা এ আয়োজনে যথোপযুক্ত ব্যক্তিদের পেতাম। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে একবার আমরা স্পিকার শিরীন শারমিনকে এনেছিলাম। গতবছরও তাকে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ব্যস্ততা থাকায় তিনি আসতে পারেননি।
গতবার ড. হাসান মাহমুদ এসেছিলেন। এবার যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচন, তারা ব্যস্ত। তাই এবার আমাদের মতো করে দিবসটি আয়োজন করতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ড. আব্দুল করিম মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সঙ্গে জড়িত দু’জনকে সংবর্ধিত করা হবে। বাকি আয়োজনগুলো সংক্ষিপ্ত পরিসরে আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপিত হবে।
টিডিসি: বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে শিক্ষার্থীদের কি উপদেশ দিবেন?
ড. শিরীণ আখতার: তোমরা পড়াশোনা করবে, ক্লাস করবে। রাজনীতি সচেতন থাকবে। অপরাজনীতি করবে না। তোমাদের হৃদয়টা যদি মানবিকতায় ভরপুর হয়, সেখানে অন্য কিছু জায়গা করে নিতে পারবে না। তোমরাই আমাদের শক্তি।
টিডিসি: আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. শিরিন আখতার: টিডিসিকেও ধন্যবাদ।