প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৫৮ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। বিশ্বের একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাস হিসেবেও পরিচিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে গাছগাছালি আর পাহাড়ের কোলে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। আয়তনের দিক থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ২৩০০ একরের বৃহৎ পাহাড়ি ও সমতল ভূমি নিয়ে যা বিস্তৃত। আজ ৫৭ বছর শেষ করে ৫৮ বছরে পদার্পণ করেছে সবুজঘেরা এ ক্যাম্পাস। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে আছে কিছু কালো অধ্যায়ও।

শুরু থেকে বর্তমান
১৯৬৬ সাল বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি—এ চারটি বিভাগ, ৭ জন শিক্ষক ও ২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয়েছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। চবির প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদের অধীনে বিভাগ আছে ৫২টি। শিক্ষক কর্মচারী আছে প্রায় ১ হাজার। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮ হাজার।

শুরু থেকেই দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠ জন্ম দিয়েছে বহু গুণীজনের। উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মান্নানসহ বহু কীর্তিমান মনীষী জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।  

৫৮ বছরে ৪ সমাবর্তন
৫৭ শেষ করে ৫৮ তে পদার্পণ করলেও চবির ইতিহাসে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ৪টি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৮ বছর পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম দায়িত্ব থাকাকালীন ১৯৯৪ সালে প্রথম সমাবর্তন হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়, ২০০৮ সালে তৃতীয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সমাবর্তন। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার কয়েকবার সমাবর্তনের ঘোষণা দিয়েও ব্যর্থ। 

আবাসিক হল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৫টি আবাসিক হল, এর মধ্যে ছাত্রদের জন্য চবির আলাওল হলে আসন রয়েছে ২৬০টি, এ এফ রহমান হলে ২৫৭টি, শাহজালাল হলে ৪৭৫টি, শাহ আমানত হলে ৬৩২টি, সোহরাওয়ার্দী হলে ৩৭৫টি, শহীদ আব্দুর রব হলে ৫০৯টি ও মাস্টারদা সূর্যসেন হলে ১৭৬টি আসন রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হল আংশিকভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রী হলগুলোর মধ্যে শামসুন নাহার হলে ৪৮১টি, প্রীতিলতা হলে ৫৩১টি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলে ৫০৮টি, জননেত্রী শেখ হাসিনা হলে ৭৫০টি (আংশিক নির্মাণাধীন), মাস্টারদা সূর্যসেন হলে (আংশিক) ৩৯টি আসন রয়েছে। এদিকে ছাত্রীদের জন্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল চালু করা হয়েছে।

এ পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন যারা
প্রতিষ্ঠার সময় অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিককে প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ইউ এন সিদ্দিকী (ভারপ্রাপ্ত), অধ্যাপক এম ইন্নাস আলী, অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক আব্দুল করিম, অধ্যাপক এম এ আজিজ খান, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল মান্নান, অধ্যাপক মোহাম্মদ ফজলী হোসেন, অধ্যাপক এ জে এম নূরুদ্দীন চৌধুরী, অধ্যাপক এম বদিউল আলম, অধ্যাপক আবু ইউসুফ, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দীন (ভারপ্রাপ্ত), অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ, ডক্টর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এক এক করে বর্তমানে ১৮তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ডক্টর শিরীণ আখতার।

বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগসমূহ:

কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ—
বাংলা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, ইতিহাস বিভাগ, দর্শন বিভাগ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, আরবি বিভাগ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, নাট্যকলা বিভাগ, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, পালি বিভাগ, সংস্কৃত বিভাগ, সংগীত বিভাগ, বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগ।

বিজ্ঞান অনুষদ—
পদার্থবিদ্যা বিভাগ, রসায়ন বিভাগ, গণিত বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ, ফলিত ও পরিবেশ রসায়ন।

ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ—
একাউন্টিং বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ফাইন্যান্স বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, হিউম্যান রিসোর্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ও ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ।

সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ—
অর্থনীতি বিভাগ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ।

জীববিজ্ঞান অনুষদ—
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, মনোবিজ্ঞান বিভাগ ও ফার্মেসি বিভাগ।

ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ—
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।

মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদ—
ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস, ওশানোগ্রাফি বিভাগ ও ফিশারিজ বিভাগ। ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অন্তর্ভুক্ত বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ।

এছাড়া চারুকলা ইন্সটিটিউটের আওতাধীন চারুকলা বিভাগ, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট আওতাধীন ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন রিসার্চের আওতাধীন শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ এবং আইন অনুষদের আওতাধীন রয়েছে আইন বিভাগ।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপত্তি
প্রতিষ্ঠার ৫ বছর পরেই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর থেকেই ক্ষমতার আসনে যারা বসেছে তারাই ক্যাম্পাসে দেখিয়েছে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি। বিভিন্ন সময়ে ছোট বিষয় নিয়ে সংঘর্ষে প্রাণ দিতে হয়েছে কয়েক শিক্ষার্থীকে।

৯টি উপগ্রুপে বিভক্ত চবি ছাত্রলীগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা ৯টি উপগ্রুপে বিভক্ত। আধিপত্য বিস্তারসহ ছোট বিষয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায় নেতাকর্মীরা। গ্রুপগুলো হলো— ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স), বিজয়, বাংলার মুখ, সিক্সটি নাইন, সিএফসির দুটি পক্ষ, একাকার, এপিটাফ, কনকর্ড।

 

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার, যা দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই গ্রন্থাগারে বর্তমান সংগ্রহ সংখ্যা প্রায় ৩.৫ লাখ, যার মধ্যে রয়েছে বিরল বই, জার্নাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান, পাণ্ডুলিপি এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল বই।

শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাস
শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাস বললে মনে আসবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। চবির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই শাটল ট্রেন। বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাস এখন চবি। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১৯৮০ সালে চালু করা এটি। শিক্ষার্থীর তুলনায় ট্রেন কম হওয়ায় বেশিরভাগ সময়  ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে ২টি শাটল ট্রেন প্রতিদিন মোট ১৪ বার শহর-ক্যাম্পাস-শহর আসা যাওয়া করে। প্রতিটি শাটলে দশটি করে বগি আছে। ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর যাতায়াতে যা খুবই সামান্য। প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে শিক্ষার্থী বাড়লেও বাড়েনি শাটলের শিডিউল। বরং লোকবলের সংকটে করোনা-পরবর্তী বন্ধ করে দেওয়া হয় নিয়মিত শিডিউলের ডেমু ট্রেন। প্রতিদিন প্রায় ১৪- ১৬ হাজার শিক্ষার্থী নিয়মিত যাতায়াত করে।


সর্বশেষ সংবাদ