স্মৃতির ক্যাম্পাসে চিরঘুমে ভাষাবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক 

স্মৃতির ক্যাম্পাসে চিরঘুমে ভাষাবিদ অধ্যাপক ড মাহবুবুল হক 
স্মৃতির ক্যাম্পাসে চিরঘুমে ভাষাবিদ অধ্যাপক ড মাহবুবুল হক   © সংগৃহীত

নিজ কর্মস্থল ও ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মাহবুবুল হকের দাফন সম্পূর্ণ হয়েছে। শুক্রবার (২৬জুলাই) আসরের নামাজ শেষে তৃতীয় জানাজা শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের কবর স্থানে তাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। 

জানাজায় স্মৃতিচারণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবু তাহের বলেন, মাহবুবুল হক বাংলার শিক্ষক ছিলেন। তবে ইংরেজিতেও তাঁর পাণ্ডিত্য অসাধরণ। আমার অনেক প্রুফ রিড মাহবুব ভাই করেছেন। কিভাবে গুছিয়ে নিপূণ ভাবে প্রুফ রিড করতে হয় সেটা আমি মাহবুব ভাইয়ের কাজ থেকে শিখেছি। তাঁর কাছ থেকে হাতে-কলমে এমন অনেক কিছু শিখেছিলাম। তাঁকে আমরা হারিয়েছি। দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ হওয়ার নয়।

তার ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আশরাফুল বলেন, আমার বড়ভাই ড. মাহবুবুল হক দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ অবস্থায় গত জুন মাসে আমেরিকা থেকে দেশে আসেন। কিছুদিন পরেই ঢাকায় নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এ মাসের শুরুতে তার বাইপাস করা হয়েছিল। এর দুই দিন পর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ দিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই সময়টায় অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি কাজ করেছেন। তিনি কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। যখন যে যা চেয়েছেন তিনি তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। 

ড মাহবুবুল হক ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর ফরিদপুরের মধুখালীতে জন্মগ্রহণ করেন।  শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামেই। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে তার অনেক স্মৃতি। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ড মাহবুবুল হক। শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। পরে প্রভাষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান।

শিক্ষকতার পাশাপাশি অবদান রেখেছেন বাংলা ভাষা, প্রবন্ধ রচনা, ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, অনুবাদ, অভিধান, সম্পাদনা ও পাঠ্যবই রচনায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশ কয়েকটি বাংলা পাঠ্য বইয়েরও রচয়িতা তিনি। আহ্বায়ক হিসেবে নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের বাংলা শিক্ষাক্রম ও বাংলা পাঠ্য বই প্রণয়নে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তার।

তার চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে বাংলা বানানের নিয়ম, রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র ভাবনা, ইতিহাস ও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি এবং বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি প্রভৃতি। ড. মাহবুবুল হক প্রবন্ধে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া গবেষণায় অবদান রাখায় ২০১৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

বুধবার (২৪ জুলাই) রাত ১টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।  গতকাল (বৃহস্পতিবার)   সকালে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অধ্যাপক মাহবুবুল হকের লাশ আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় আনা হয় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাহবুবুল হকের মরদেহ সেখানে রাখা হয়। এতে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্মৃতিচারণা করে বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা।

পরে নগরীর জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদে এই ভাষাবিদকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। বাদ জুমা শেষে সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

এরপর বাদ আসর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তৃতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় কেন্দ্রীয় মসজিদের কবরস্থানে।


সর্বশেষ সংবাদ