বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ে অন্যতম সহযোগী প্রভোস্ট ও বিভাগের চেয়ারম্যান: গবেষণার তথ্য
- ইরফান এইচ সায়েম
- প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:৩৪ PM , আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৩ PM
আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক আতঙ্কের নাম ছিল র্যাগিং। বিশেষ করে নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক নির্যাতন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এক গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন যেমন জড়িত, তেমনই জড়িত বিভাগের চেয়ারম্যান ও আবাসিক হলের প্রভোস্ট। শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক হলের র্যাগিংয়ের ঘটনায় তারা পুরোপুরি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। এমনকি অনেকক্ষেত্রে ধামাচাপা দেওয়ারও চেষ্টা করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, র্যাগিংয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, আবার কেউ কেউ অপমানের কারণে আত্মহত্যা করার কথাও ভাবতে শুরু করেন। এর মধ্যে দিয়ে বিষ নামক মানসিক রোগের সাথে পরিচিত হয়ে যান সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
চলতি বছরের শুরুতে ভারতের ‘International Journal of Humanities Social Science and Management’-এ এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।
‘A Study of Ragging: Ragging is not stopping due to the authorities concerned of the institutions specially, for the chairman of the department and hall provosts in Bangladesh’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। শিক্ষক সমিতিগুলোও এর বিরুদ্ধে কথা বললেও কোনোও লাভ হয় না। যার ফলে র্যাগিংয়ের জন্য অন্যতম দায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ।
গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়, র্যাগিং-বিরোধী সেমিনার শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং শিক্ষকদের জন্যও হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও পরামর্শের প্রয়োজন, কারণ তাদের অনেকেই র্যাগিংকে সমর্থন করেন।
গবেষণাপত্রটিতে উল্লেখ করা হয়, আবাসিক হলের গেস্টরুম এবং ক্লাসরুমের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে যেকোনো জায়গায় র্যাগিংয়ে ঘটনা ঘটতে পারে। জড়িতদের অনেকের মতে, এগুলো র্যাগিং নয় বরং এই ধরনের কার্যকলাপ জুনিয়র-সিনিয়রদের মধ্যে সর্ম্পক বৃদ্ধি করে। তারা মনে করে, বুয়েটের আবরার ফাহাদের হত্যা র্যাগিংয়ের উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু তারা যে অপরাধ করে তা র্যাগিং নয়।
গবেষণাপত্রটির লেখক ঢাকার সেন্টার ফর রিসার্চ ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরআইডি) এর বায়োইনফরমেটিক্স রিসার্চ ল্যাবের গবেষক সৈয়দ আশিকুজ্জমান আশিক।
তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং কালচারের সঙ্গে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরিচিত। গবেষণাপত্রটিতে দেখিয়েছি, এটার জন্য প্রধানত দায়ী হল প্রভোস্ট ও বিভাগের চেয়ারম্যান। কারণ এসব ঘটনায় পুরো দায়িত্বহীন পরিচয় দেন তারা।
‘ধরুন আপনি বাসে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন, এজন্য যাত্রী হিসেবে আপনাকে দেখভাল করতে বাসের সুপারভাইজার-হেল্পার থাকবেন। তারা আপনার পর্যবেক্ষণ করবেন। পাশাপাশি সুবিধা-অসুবিধাও দেখবেন। ঠিক তেমনি একজন ছাত্রের জন্য হল প্রভোস্ট ও বিভাগের চেয়ারম্যান দায়িত্বও একই । কারণ তাদেরকে সরকার বেতন দিচ্ছে।’
গবেষণাপত্রটির লেখক সৈয়দ আশিকুজ্জমান আশিক
চীনের ল্যানঝো ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিরত এই গবেষক বলেন, র্যাগিংয়ের বিচার চাইতে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ জানাতে প্রক্টরের কাছে যেতে চাইলেও অনেক সময় হল প্রভোস্ট ও বিভাগের চেয়ারম্যান স্বয়ং বাধাও দিয়ে থাকেন। কারণ বিষয়টি জানাজানি হোক তা তারা চান না। আবার অনেক সময় বিচার হলেও জড়িতদের বহিষ্কার হয়।
‘উদাহরণস্বরূপ, র্যাগিংয়ের দায়ে যাদি বিভাগের কোনো সিনিয়ার যদি বহিষ্কার হয়, তখন ক্লাসে ভুক্তভোগীকে বলাবলি করে তোর কারণে সিনিয়রদের সঙ্গে সর্ম্পকটা খারাপ হয়েছে। ইগনোর করেন সহপাঠীরা এবং কিন্তু ভুক্তেভোগহী মানসিকভাবে হেনস্তা হতে হয়।’
তিনি বলেন, এসব ঘটনা এড়াতে হল প্রভোস্ট ও বিভাগের চেয়ারম্যানরা কার্যকর ভূমিকার রাখতে পারতেন। যেহেতু হল ও শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি হলে হাউজ টিউটরও সার্বক্ষণিক রয়েছেন। তাছাড়া কর্মচারীরা তো আছেই। তাই এসব ঘটনায় গাফিলতি রয়েছে হল প্রভোস্ট ও বিভাগের চেয়ারম্যানে। তারা উদ্যোগী হলে র্যাগিংয়ের ঘটনা ৮০ শতাংশ কমে যাবে।
গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়, র্যাগিং-বিরোধী সেমিনার শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং শিক্ষকদের জন্যও হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও পরামর্শের প্রয়োজন, কারণ তাদের অনেকেই র্যাগিংকে সমর্থন করেন।
‘র্যাগিংয়ের বিচার করা কর্তৃপক্ষের শেষ দায়িত্ব নয়, তাদের অবশ্যই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে মানসিক সহায়তা দেওয়ার জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায়, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের উপর এর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।’
আজ শুক্রবার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে প্রকাশিত ‘ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে দেয়নি, রুমে আদায়ের পর ফের শুরু ছাত্রলীগের নির্যাতন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে তৎকালীন প্রক্টর-প্রভোস্টের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ঘটনার ভুক্তভোগী দর্শন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. শাহ রিয়াদ হোসেন বলেন, সেদিন ভোরে শারীরিক নির্যাতনের জন্য বিচার না করে উল্টো হল থেকে বের করে দেন হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল বাছির। সহযোগিতা নেন তৎকালীন ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রাব্বানীর।
গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে র্যাগিং-নির্যাতনের অহরহ ঘটছে। তবে এসব ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে একটি হলের তৎকালীন প্রভোস্ট দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ছিল। সেক্ষেত্রে ছাত্রদের কিভাবে সেফ করা যায় সেটা মাথায় থাকতো। কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কাছে আমরা সব সময় অসহায় থাকতাম। এক প্রকার তাদের কথা মতো চলতে হতো প্রশাসনকে।