যে ছয়টি কাজ নিষিদ্ধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ করে

দেয়ালে পোস্টার লাগানোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও চিকা মারা হয়েছে
দেয়ালে পোস্টার লাগানোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও চিকা মারা হয়েছে  © প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে কিছু কাজে স্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, অনেক মানুষ স্বভাবতই নিয়ম ভাঙতে অভ্যস্ত। সরকারি আইন, সামাজিক শৃঙ্খলা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনে ছয়টি সাধারণ নিষিদ্ধ কাজের বিশ্লেষণ করা হলো, যা বাংলাদেশের মানুষ নিয়মিতভাবে করে থাকেন।

১. দেয়ালে চিকা মারা
বাংলাদেশের শহর কিংবা গ্রাম—যেখানেই যান না কেন, দেয়ালে নানা ধরনের লেখা চোখে পড়বে। সরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ির দেয়ালে স্পষ্টভাবে লেখা থাকে “দেয়ালে লিখিবেন না”, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই জায়গাতেই বেশি পোস্টার ও চিকা মারা হয়। রাজনৈতিক প্রচারণা, কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচারণার জন্য দেয়াল ব্যবহার করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. ময়লা ফেলা নিষিদ্ধ স্থানে বেশি ফেলা
বাংলাদেশের বিভিন্ন সড়ক, অলিগলি কিংবা খোলা জায়গায় “এখানে ময়লা ফেলবেন না” লেখা থাকলেও ঠিক সেখানেই সবচেয়ে বেশি আবর্জনা জমতে দেখা যায়। মূলত সচেতনতার অভাব, নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গার অভাব এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে মানুষ নিয়ম মানতে চায় না। অনেকে মনে করেন, একজন ফেললে কিছু হবে না—এতেই পরিবেশ দূষণ ঘটে সবচেয়ে বেশি।

৩. পার্কিং নিষিদ্ধ এলাকায় গাড়ি রাখা
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় কিংবা বড় শহরগুলোতে “পার্কিং নিষেধ” লেখা বোর্ড থাকা সত্ত্বেও মানুষ ঠিক সেখানেই গাড়ি বা মোটরসাইকেল রেখে যায়। ট্র্যাফিক আইন মেনে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্কিং করার পরিবর্তে অনেকেই ফুটপাথ বা রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে যান, যা যানজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যথাযথ মনিটরিং ও জরিমানার হার কম থাকার কারণে এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

৪. ধূমপানের নিষিদ্ধ স্থানে ধূমপান করা
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যে-সব জায়গায় “ধূমপান নিষেধ” লেখা থাকে, ঠিক সেখানেই অনেকে সিগারেট ফুঁকতে থাকে। সচেতনতার অভাব, ব্যক্তিগত উদাসীনতা এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে মানুষ এসব জায়গায় ধূমপান করেই চলে।

৫. সিএনজি গাড়ির পেছনে বিজ্ঞাপন লাগানো
অনেক সিএনজি চালিত গাড়ির পেছনে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে, “বিজ্ঞাপন লাগাবেন না”। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো অনেক সিএনজি অটোরিকশার পেছনে বিজ্ঞাপন লাগানো হয়। বিশেষ করে কোচিং সেন্টার, গৃহঋণ, মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন ব্যবসার বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য সিএনজির পেছনে পোস্টার লাগানো হয়।

৬. “এখানে প্রস্রাব করবেন না” বোর্ড থাকার পরও সেখানে প্রস্রাব করা
বাংলাদেশের অনেক দেয়ালে বড় অক্ষরে লেখা থাকে “এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ" বা “প্রস্রাব করলে জরিমানা”—কিন্তু দেখা যায়, ঠিক সেই জায়গাতেই মানুষ মূত্রত্যাগ করছে। শহরের রাস্তা-ঘাটে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের অভাব, ব্যক্তিগত শৃঙ্খলার অভাব এবং আইনের শিথিল প্রয়োগের কারণে এই সমস্যাটি এখনো ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। এমনকি কিছু জায়গায় ধর্মীয় লেখা দিয়ে এই অভ্যাস বন্ধ করার চেষ্টা করা হলেও অনেকেই নিয়ম মানে না।

কেন মানুষ নিষিদ্ধ কাজ করেই চলে?
পরিবেশের সৌন্দর্যের স্বার্থে ব্যক্তির পুরো সমাজকে আপন মনে না করাটাকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব।

তিনি বলেন, ‘আপনার উল্লিখিত অভ্যাসগুলো অপরাধ নয়; বরং এগুলো ডেভিয়েন্ট বিহেভিয়ার। অর্থাৎ, এমন কোনো কাজ বা আচরণ যা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন, নৈতিকতা বা আইনের বিরুদ্ধে যায়। এটি সবসময় অপরাধ নাও হতে পারে, তবে এটি সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। এগুলোর জন্য কোনো শাস্তি নেই। যেমন- যেখানে সেখানে ময়লা ফেলাটা সামাজিক নিয়ম বা মূল্যবোধের পরিপন্থী।’

তিনি ব্রোকেন উইন্ডোজ থিওরির কথা উল্লেখ করেন এসময়। এই তত্ত্বের মূল ধারণা হলো, যেখানে ছোটখাটো অপরাধ উপেক্ষা করা হয়, সেখানে বড় অপরাধের জন্যও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।

সহকারী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, ‘এই তত্ত্ব মতে, আপনি যখন কোনো অনিয়ম দেখেন এবং প্রম্পট (দ্রুত) ব্যবস্থা না নেন তখন সেগুলো দিনদিন বাড়তে থাকে। ধরেন, কোনো জায়গায় ডাস্টবিন নেই। আপনি ময়লা ফেললেন। ঠিক ওই জায়গায় আপনার দেখাদেখি আরেকজন ফেলছেন। 

উন্নত বিশ্বে এই নর্মস এন্ড ভ্যালুস ভঙ্গ করলে তিরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনি ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে এসব কাজ করবেন না। কারণ সেখানে এসমস্ত নর্মস এন্ড ভ্যালুস সবাই আত্মস্থ করে, পালন করে। এসব ব্রেক (ভঙ্গ) করলে তিরস্কারের ব্যবস্থা আছে। 

সামাজিক মূল্যবোধ মানার ক্ষেত্রে সচেতনতার চর্চা করাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এই অপরাধবিজ্ঞানী।

তিনি বলেন, ‘সমাজের প্রতি ওনারশিপ ডেভেলপ করতে হবে। এটা আমার দেশ। আমার সমাজ। ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে পারবেন না যতক্ষণ আপনি মানুষের মনে এই জিনিসটা ঢুকাতে পারবেন যে, ঠিক জায়গায় ময়লা ফেলা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আপনি শাস্তি দিয়ে সেটা বন্ধ করতে পারবেন না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ। আমি যদি আজকে পরিবর্তন হই, তাহলে সমাজ পরিবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের একটা প্রবণতা আছে যে, সবাই করছে, আমি একা না করলে কী এমন পরিবর্তন হবে? কিন্তু কাজটা একাই শুরু করতে হবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা যাবে। সেক্ষেত্রে সমাজকে, দেশকে, পরিবেশকে নিজের মনে করতে হবে।’ 


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!