সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দোকানে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি, ভাগ পেতেন সৈকত

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে বসানো সারি সারি দোকান
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে বসানো সারি সারি দোকান  © টিডিসি ফটো

নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেন্দ্রীক অবৈধ দোকান সিন্ডিকেট থামানো যাচ্ছে না। দিন দিন দোকানের সংখ্যা বাড়ছেই। এর সঙ্গে বাড়ছে চাঁদাবাজিও। নানাভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাসে লাখ লাখ টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও তাদের স্বজনদের বিরুদ্ধে। এর ভাগ পেতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। দোকান অবৈধ হওয়ায় এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন ব্যবসায়ীরাও। এর আড়ালে মাদক কারবারিরও অভিযোগ রয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের বাইরে (টিএসসি) ও এর আশপাশে চা, সিগারেট, ফুচকা, আইসক্রিমসহ বিভিন্ন খাবার ও প্রসাধনীর দোকান ছিল। টিএসসি এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম হওয়ায় এসব দোকানেও বিক্রিও ভালো হয়। তবে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব দোকান তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাবি প্রশাসন।

১৬৪ দোকান থেকে গড়ে ২৫০ টাকা করে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় ৪১ হাজার টাকা। সে হিসাবে মাসে ১২ লাখ টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এছাড়া দোকান স্থাপনের জন্য দোকানিদের অগ্রিম দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। সে হিসেবে এককালীন ৮ লাখ টাকার বেশি আদায় করা হয়েছে।

এতে ক্যাম্পাস থেকে দোকান সরাতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। এরপর টিএসসি এলাকায় অনুমতি ছাড়া দোকান বসতে দেওয়া হয়নি। টিএসসি সংলগ্ন হওয়ায় এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে দোকান বসাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, আগে উদ্যানের ভেতর ২০-৩০টি দোকান ছিল। পরে এ সংখ্যা বেড়ে দেড় শতাধিক হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি টিএসসিতে ১০টি দোকান বসানোর অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবৈধ দোকান আছে ১৬৪টি। এ সংখ্যা প্রতিদিন চাঁদার ওপর নির্ভর করে কমবেশি হয়। এরমধ্যে সিগারেট ও চায়ের দোকান ২৪টি, শিঙাড়া ও চপের ১৪, ফুচকা ৩০, কাবাব ৭, আইসক্রিম ১৫, সাজসজ্জাসহ বিভিন্ন প্রসাধনী ২৯, শরবত ১৫, পিঠা ৫, চিকেন মমো ১৯, কাপড় ২, আচার ৭ ও দইয়ের দোকান রয়েছে তিনটি।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব দোকান থেকে গড়ে ২৫০ টাকা করে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় ৪১ হাজার টাকা। সে হিসাবে মাসে ১২ লাখ টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এছাড়া দোকান স্থাপনের জন্য দোকানিদের অগ্রিম দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। সে হিসেবে এককালীন ৮ লাখ টাকার বেশি আদায় করা হয়েছে।

আরো পড়ুন: ‘মাথা-বুক রক্তে ভিজে যায়, বাঁ চোখ চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি’

কয়েকজন দোকানি জানিয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক নিজামুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অধিকাংশ দোকান তাঁর নিয়ন্ত্রণে। দোকান দেখাশোনা ও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বাবা শাহজাহানের বিরুদ্ধে। একই কমিটির সহ-সভাপতি খোকা উদ্যানের লাইনম্যান হিসেবে দায়িত্বরত। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক কারবারেরও অভিযোগ রয়েছে। আরেক নেতা অলি শিশু পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইউনিট স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। গাঁজা বিক্রির অভিযোগে তিনি কয়েকবার জেলেও গেছেন।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিজামুদ্দিনের মামাতো ভাই নান্নু। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে দোকানিদের এনে উদ্যানে বসিয়ে ৫ হাজার টাকা করে আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ভাই রমিজও চাঁদাবাজিতে যুক্ত বলে জানা গেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতেন। চাঁদার অংশ তাকেও দিতে হত।

সে সময় স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ ও খাবারের আয়োজনও করতেন তারা। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের বিএনপির পক্ষে ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার করেছেন। এর কিছু প্রমাণও ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত ৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেন শাহজাহান। তিনি কোনও রাজনৈতিক পদে না থাকলেও তাঁর ছেলে নিজামুদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক লীগের শিশু পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক। শাহজাহানের স্ত্রীর নামেও দোকান আছে। প্রতিদিন প্রত্যেক দোকান থেকে বিদ্যুৎ বিল উঠান ৫০-৬০ টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে অনেককে নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে।

আরেক দোকানির ভাষ্য, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপকরণ সরবরাহ করতেন শাহজাহান। কাঙালি ভোজের আয়োজনও তারাই করতেন। উদ্যানে অবৈধভাবে বিদ্যুৎতের লাইন নিয়ন্ত্রণ এবং মোবাইল টাওয়ারে ডিউটি না করে টাকা নেন তারা। সবকিছুর হোতা শাহজাহান। এছাড়া অনেকে প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রি করেন। তাদের নিরাপত্তায় ৫-৬ জন লোক থাকে। তাদের কাছে থাকে দেশী অস্ত্র।

আরো পড়ুন: ৪ মাস পর শাবিপ্রবির একাডেমিক কার্যক্রম ও আবাসিক হল চালুর সিদ্ধান্ত 

চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে শাহজাহান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৩০-৩৫ বছর ধরে আমি উদ্যানে কাজ করি। কোনোদিন চাঁদাবাজি করিনি। আমি এ ধরনের ছেলে না।’ বিএনপি নিয়ে পোস্ট শেয়ার দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে যখন আমি এখানে এসেছি, তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তাদের সাথে চলছি, ফিরছি, খাইছি, দোকানদারি করছি। যে ক্ষমতায় আছে সেই আমার কাছে ভালো, কেউ আমার কাছে খারাপ না।’

শাহজাহানের মামাতো ভাই নান্নু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কোনো দোকানদার যদি বলে আমি চাঁদাবাজি করি, তাহলে তাই। আমার এ বিষয়ে কিছু বলার নেই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত কারাগারে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস কে বলেন, ‘এ ব্যাপারে  আমি পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা শিগগিরই অভিযান চালাবে। আমরাও চাই, এর একটা সঠিক সমাধান হোক।’

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালিদ মুনসুর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। কে বা কারা চাঁদাবাজি করে, তাদের নামসহ তথ্য পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ