ফেসবুকে ভাসছে বিসিএস থেকে বাদ পড়া ৫ ক্যাডারের আবেগি স্ট্যাটাস

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়  © লোগো

৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে আড়াই শতাধিক সুপারিশকৃত ক্যাডারকে বাদ দিয়ে গেজেটের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ইতোমধ্যেই বাদ পড়া প্রার্থী সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হয়ে আন্দোলন করেছেন। দাবি তুলেছেন পুনরায় গেজেট প্রকাশের। এজন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছেন তারা।

জনপ্রশাসন বলছে, গেজেটের বাইরে থাকা প্রার্থীরা ‘সাময়িক অনুপযুক্ত’ হয়েছেন ‘গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বিবেচনায়‘; যাদের পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।

তারা বলছেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী ২২৭ প্রার্থীর প্রাক্‌-চরিত্র বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য (আপত্তি/অসুপারিশকৃত) পাওয়া যায়। ২২৭ প্রার্থীর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্যের কারণে সাময়িকভাবে নিয়োগের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচনা করা হয় এবং তাঁদের বিষয়ে অধিকতর যাচাই-বাছাই ও খোঁজখবর নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০ জনকে নিয়োগের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় সুপারিশ করা ২ হাজার ১৬৩ প্রার্থীর মধ্য থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০ জন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বিবেচনায় সাময়িকভাবে অনুপযুক্ত ২২৭ জনসহ মোট ২৬৭ জনকে বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ১ হাজার ৮৯৬ প্রার্থীর অনুকূলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

এদিকে বাদ পড়ার পর থেকেই সুপারিশ পাওয়া ক্যাডারদের বিভিন্ন স্ট্যাটাস লক্ষ্য করা গেছে। এমনই একজন কাঞ্জিলাল রায় জীবন। তিনি লিখেছেন, ‘গত ১৫ অক্টোবরে প্রকাশিত ৪৩ তম বিসিএসের গেজেটে আমার নাম ছিল। আজ প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসের গেজেটে আমার নাম নেই। কেন গেজেটে আমার নাম নেই, কেন কোন ধরনের ফৌজদারী অপরাধে নূন্যতম সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও আমি বৈষম্যের শিকার হলাম, কেন কোন ধরনের সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত না থাকার পরেও আমাকে প্রজাতন্ত্রের সেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল তা আমার জানা নেই।’

‘তবে আমার জানার খুবই ইচ্ছা। আমি শুধু জানি আমি সততার সাথে পরিশ্রম করেছি। আমি শুধু জানি আমি আর দশজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মত আমার মা-বাবার সীমাহীন কষ্ট, আমার পরিবার-পরিজন, শিক্ষক-এলাকাবাসীর আশার প্রতিদান দিতে আমার চেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি রাখিনি। আমি শুধু জানি আমি কারো সুপারিশে, কোন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিসিএস ক্যাডার হইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান গ্রন্থাগার আমার পরিশ্রমের স্বাক্ষী। ভোর ৫ টায় উঠে লাইব্রেরিতে ব্যাগ রেখে এসে রান্না করে দুপুরের খাবার সাথে নিয়ে গিয়ে, টিউশন করিয়ে নিজের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে পরিশ্রম করেছিলাম। স্রষ্টা আমাকে বিসিএস ক্যাডার করেছিল, একবার গেজেটভুক্তও করেছিল। তবুও আজ আমি বৈষম্যের শিকার হলাম।’

মেহনাজ স্বর্ণা লিখেছেন, ‘ভার্সিটি লাইফে কোন রাজনৈতিক দলের ছায়াও মাড়াইনি, নিয়মিত ক্লাস আর পড়াশোনার মাঝেই ছিলাম। ডিপার্টমেন্টের রেজাল্টও নেহাতই মন্দ নয়। আমি কেমন ছিলাম তা আমার হল, ডিপার্টমেন্টের ব্যাচমেট, সিনিয়র-জুনিয়র বলতে পারবে। কোন প্রকার রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সংশ্লিষ্টতা নেই, নেই কোন মামলা। এই ৪৩ বিসিএসের মেডিকেল এটেন্ড করার জন্যই এনএসআই এডি থেকে ট্রেনিং চলাকালে স্বেচ্ছায় এবং সসম্মানে অব্যাহতি নিয়ে চলে আসি। তারপর থেকে অপেক্ষা করি বিসিএসে জয়েনিং এর জন্য।’

তিনি আরও জানান, ‘চাকরি ছাড়ার পরও আমার ২টি ভাইভা হাতে ছিল, আরেকজনের রিজিকের ব্যবস্থা হোক তাই এটেন্ড করি নাই। আর চাকুরীকালীনও কয়েকটি রিটেন ভাইভায় অংশগ্রহণ করিনি যেহেতু শিক্ষা ক্যাডারে জয়েন করব বলে ঠিক করেছিলাম। আমার বাবা একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ছা-পোষা জীবন পার করেছি আমরা। আমার পরিবারের কেউ রাষ্ট্র বিরোধী কোন কাজে জড়িত নেই এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও নেই। আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট গোপালগঞ্জ। এটি ছাড়া আপাতত বাদ পড়ার আর কোন কারণ দেখছি না। যতই নিজেকে বোঝাই ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে, এমন পরিস্থিতিতে কতক্ষণ নিজেকে সামলানো যায়। পূর্বে আমি ট্রাস্ট ব্যাংক এমটিও, জনতা ব্যাংক সিনিয়র অফিসার, ৪১ তম নন-ক্যাডার জুনিয়র ইন্সট্রাক্টরে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। একসময় হাতে একাধিক চাকরি ছিল, এখন আমার কিছু নেই। আমি আর আমার পরিবারের সদস্যরা যে ট্রমার মধ্যে আছি তার দায়ভার কে নেবে? আমার পাঁচ বছর ইনভেস্ট করা, ধৈর্য্য নিয়ে পড়ে থাকা অর্জন করা চাকরিতে কেন প্রথমবার গেজেটভুক্ত হয়েও দ্বিতীয়বার বাদ পড়লাম বৈষম্যহীন বাংলাদেশে এই জবাব তো আমি চাইতেই পারি, না?’

গেজেট থেকে বাদ পরা ৪৩ বিসিএসে সহকারী কমিশনার আব্দুল বাসিতকে নিয়ে তালহা মুহাম্মাদ লিখেন, ‘সহকারী জজ (১৪শ বিজেএস, মেধাক্রম-৯), সহকারী কমিশনার (৪৩ বিসিএস, মেধাক্রম-৫), সহকারী পরিচালক (বাংলাদেশ ব্যাংক, মেধাক্রম-১৬) সহ বেশ কয়েকটি চাকরি নিজের মেধায় অর্জন করেন আব্দুল বাসিত ভাই। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অজ্ঞাত কারণে সহকারী জজ হিসেবে বাসিত ভাইয়ের গেজেট হয় নাই। তখন বাসিত ভাইসহ মোট ১৪ জনের গেজেট আটকে যায়। গত আমলে কেন গেজেট আটকে দেয়া হতো তা সবারই জানা।’

‘ব্যাচের অন্য সবার একমাস পরে এই ১৪ জনের গেজেট হয়। তাদের বহুত দৌড়াদৌড়ি করে গেজেট আদায় করতে হয়েছিল। গত অক্টোবর মাসে ৪৩ বিসিএসের গেজেট হয়। সেই গেজেটে আবদুল বাসিত ভাইয়ের নাম ছিলো। নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে পুনরায় পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে আজ আবার ৪৩ বিসিএসের গেজেট হয়। এই গেজেটে বাসিত ভাইয়ের নাম নাই। কেন নাম নাই? কর্তৃপক্ষই হয়ত ভালো বলতে পারবেন। আমার দেখা বাসিত ভাই একমাত্র ব্যক্তি যার আওয়ামী লীগ আমলেও চাকরির গেজেট আটকাই গেছিলো, আবার আওয়ামী লীগকে হটানো সরকারের আমলেও গেজেট আটকাই গেলো। অথচ বাসিত ভাই কোটা আন্দোলন এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষেও অনলাইনে সরব ছিলেন।’

ন্যায় বিচার চেয়ে সাইফুল ইসলাম লিখেন, ‘৪৩ তম বিসিএস এর ফলাফলে যখন নিজের রোলটা পুলিশ ক্যাডারে দেখেছিলাম তখন আম্মাকে ফোন দিয়ে কেঁদেছিলাম কারণ অসহায়ের সাহস হওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়েছে। সেদিন সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলাম যেন ন্যায় আর ন্যায্যতায় থাকতে পারি। আজ ৪৩ তম বিসিএস এর রি-গেজেট যখন হল তখন দেখি আমার নামটা নেই। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি আমি কিংবা আমার বাবা, মা, ভাই বোন এবং আমার স্ত্রী কিংবা আমার স্ত্রীর বাবা, মা ভাই, বোন কেউই কোন ধরনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয়। কোন ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় আমার কিংবা এদের কারোরই নেই। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমি কিংবা এদের কারো কোন ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল/ আছে কিংবা আমি বা এদের কেউ কোন রাষ্ট্র বিরোধী কাজে জড়িত ছিলাম / আছি তাহলে প্রকাশ্যে যে শাস্তি দেওয়া হয় সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব। আমার জানা নেই কেন আমাকে গেজেট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে; ন্যায় বিচার চাই।’

‘বিসিএসের যাত্রা এখানেই শেষ’ উল্লেখ করে প্লাবন সাহা নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘৪৩ এর রিগেজেটে দেখলাম আমার নাম নাই, আমি দেশের বাইরে থাকায় এই জিনিসগুলা নিয়ে খুব বেশি কানেক্টেড ছিলাম না। টুকটাক খবর পাইতাম, রিগেজেট ব্যাপার টা যা বুঝলাম, কারো কোন পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন (সংযোগ) বা কোন প্রিভিয়াস (পূর্ববর্তী) রেকর্ড থাকলে সেটা চেক করে। আমি বা আমার ইমিডিয়েট ফ্যামিলির সাথে কখনই কোন প্রকার পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন ছিল না, আমার নামে কোন সুপারিশ ও করা নেই, তাই আমার নাম গেজেট এ না থাকার ব্যাপার টা একটু খটকা লাগলো।’ 

‘আমি মোটামুটি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি আমাকে নন গেজেটেড করার কোন কারণ আমি দেখি না। একটু খোঁজ নিয়ে দেখলাম সব ক্যাডার মিলায়ে বাদ পড়েছে প্রায় ২৬৭ জন। সংখ্যাটা অনেক বড়, এর মধ্যে অনেক কে আমি চিনি যাদের সাথে কোন পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন নাই। আর একটু খোঁজ নিয়ে জানলাম, ৪৩ বিসিএস এডমিন থেকে যতজন বাদ পড়ছে তার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সনাতনী। আমি নিজে কখনই বিশ্বাস করি না যে, ধর্ম ও এইসব ব্যাপারে কাউকে ভেরিফাই করার একটা ক্রাইটেরিয়া হতে পারে, আমি বিশ্বাস করতেও চাই না এটা হইছে, কিন্তু যদি এটা আসলেও হয় তাহলে একটা কথাই বলি-‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ আমার ফ্যামিলি বরাবরই আমাকে বলে আসছে যাতে আমি আমেরিকাতেই আমার পিএইচডিটা শুরু করি।’


সর্বশেষ সংবাদ