৪৩তম বিসিএসের সুপারিশ থেকে রেকর্ড ৯৯ জন বাদ, নেপথ্যে কি শুধু নেতিবাচক প্রতিবেদন? 

সম্প্রতি ৪৩তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
সম্প্রতি ৪৩তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়  © ফাইল ফটো

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশের দীর্ঘ ১০ মাস পরে মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) ৪৩তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গেজেটে নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ৯৯ জন  বাদ পড়েছেন। অন্যান্য বারও গেজেট থেকে বাদ পড়ার দৃষ্টান্ত আছে। তবে এবারই কয়েকটি বিসিএস থেকে সর্বোচ্চ ৯৯ জন বাদ পড়লেন। মেধার প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হলেও ঠিক কী কী কারণে প্রার্থীরা বাদ পড়লেন, এ সম্পর্কে সাধারণত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা।

৪৩তম বিসিএস থেকে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা পিএসসি’র গেজেটে দেখা যায়, ২ হাজার ৬৪ জনকে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ক্যাডারে মোট বাদ পড়েছেন ৯৯ জন। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে বাদ পড়েছেন ৭ জন ও পুলিশ ক্যাডারে বাদ পড়েছেন ৪ জন। এ ছাড়াও অন্যান্য ক্যাডারে বাদ পড়েছেন বাকিরা।

পিএসসি বলছে, সুপারিশের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এই দুটি রিপোর্ট খারাপ হলে প্রার্থীদের নাম গেজেট থেকে বাদ দেওয়া হয়।

পিএসসি’র যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রার্থীরা কী কারণে বাদ পড়েছেন তা পিএসসির পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কেননা ভেরিফিকেশন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট পিএসসি দেখে না। এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।

৯৯ জন প্রার্থীর বাদ পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব রাহিমা আক্তার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রার্থীরা কেন বাদ পড়েছেন তা প্রতিবেদনে বলা আছে। প্রতিবেদনটি গোপনীয়। এটি প্রকাশযোগ্য নয়। তবে সুপারিশের পর গেজেট থেকে বাদ পড়া কোনো প্রার্থী যদি আবেদন করেন, তাহলে তার বিষয়টি পুনরায় চেক করে দেখা হবে।’

এবার বাদ পড়লেন সর্বোচ্চসংখ্যক
দেশে চাকরির বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতা কারও অজানা নয়। এ প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে, দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে একজন প্রার্থীর বিসিএস ক্যাডারের স্বপ্ন পূরণ হয়। তবে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভায় উত্তীর্ণ হলেই চাকরি চূড়ান্ত নয়। মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে ‘পুলিশ যাচাইকরণ’ করে থাকে। অনেকের অভিযোগ, এ সময় বেশকিছু কারণেই সুপারিশপ্রাপ্ত অনেকেই বাদ পড়েন।

জানা গেছে, ৪১তম বিসিএসের গেজেট থেকে বাদ পড়েন ৬৭ জন, ৪০তম বিসিএস থেকে ৩৪ জন, ৩৭তম বিসিএস থেকে ৬১ জন, ৩৮তম থেকে ৭৫ জন এবং ৩৬তম থেকে ৩৮ জন বাদ পড়েছিলেন।

পিএসসির সুপারিশের পর যারা বাদ পড়েন, তাদের ক্ষেত্রে বাদ পড়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ না বললেও এর আগে বাদ পড়া প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রশাসন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া ভেরিফিকেশেনে নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে তারা বাদ পড়েছিলেন। অনেকে অভিযোগ করেন, ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ যাচাই করতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়। এতে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হয় না দাবি তাদের।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৪৩তম বিসিএসের গেজেট থেকে প্রায় শতাধিক প্রার্থীর বাদ পড়া নিয়ে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরেও বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা না হওয়া, রাজনৈতিক মনোভাবের কারণে অনেকে বাদ পড়েছেন বলে শুনেছি। তবে এমনটি হওয়া উচিত নয়’ বলে জানিয়েছেন এ কর্মকর্তা।

বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে কাজ করেছেন সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী শরিফুল হাসান। সুপারিশপ্রাপ্তদের বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘লক্ষাধিক প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যখন কেউ বিসিএস ক্যাডার হন, তখন তার রাজনৈতিক তালাশ করা অপরাধ। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরে ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত শতাধিক প্রার্থীর নিয়োগ এই রাজনৈতিক তালাশের পর আটকে ছিল তুচ্ছ সব কারণে। অবশ্য সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট তাদের সবার নিয়োগের গেজেট হয়েছে। অন্যদিকে ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক তালাশে ৪৩ তম বিসিএসের গেজেট থেকে বাদ পড়েছেন ৯৯ জন। এ যেন রাজনৈতিক রং খোঁজার সেই পুরোনো অপচর্চা!’

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া একজনকেও আটকে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অন্যায়। এটা অনৈতিক চর্চা। এই সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিত।’ এখন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনা
মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে ‘পুলিশ যাচাইকরণ’ করে থাকে। সাধারণত এই ভেরিফিকেশন করে থাকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবি শাখা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার অন্য গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিসি অফিস দিয়েও কাজটি করেছেন। এতে ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ খোঁজার প্রবণতায় বাদ পড়েছেন অনেকেই। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একইভাবে অন্য গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিসি অফিস দিয়ে ভেরিফিকেশনের কাজ করেছেন। ‘রাজনৈতিক পরচিয়’ থাকায় তাদের কেউ কেউ বাদ পড়েছেন।

জানা গেছে, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক যাচাই ফর্মে দেওয়া ১৬ ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়। শিক্ষার্থীরা কোথায় লেখাপড়া করেছেন, সর্বশেষ পাঁচ বছর কোথায় থেকেছেন, কিংবা তার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারি বা অন্য কোনো মামলায় গ্রেফতার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্য চাওয়া হয়। অনেকে অভিযোগ করেন, এ সময় প্রার্থীর কিংবা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় বের করার চেষ্টা হয়। এটা অনৈতিক ও আইনবিরোধী হিসেবে অভিহিত করেন তারা।

সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী শরিফুল হাসান বলেন, ‘শুধু নিয়োগ নয়, চাকুরিতে যোগ দেওয়ার পরেও রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজার সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিত। এই যে চাকুরিতে যোগ দেওয়ার পরে একজন কর্মকর্তা সুবিধা পেতে নানা সময়ে নানা দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা খোঁজেন এটিও অনুচিত। রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই সরকারি চাকুরির যোগ্যতা বা অযোগ্যতা হতে পারে না। বরং একজন কর্মকর্তার নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতিতে মেধা, সততা ও যোগ্যতাই বিবেচ্য হওয়া উচিত।’

আওয়ামী লীগ শাসনামলে গত ১৫ বছর ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পর পুলিশের নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে গেজেট থেকে বাদ পড়েছেন ২৫৯ প্রার্থী। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৪ আগস্ট বাদ পড়া ২৫৯ প্রার্থীকে নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। 

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে রাজনৈতিক কারণেই ২৫৯ প্রার্থীকে চূড়ান্ত গেজেট থেকে বাদ দিয়েছিল। একইভাবে রাজনৈতিক কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার ৪৩তম বিসিএসের সুপারিশ থেকে রেকর্ড ৯৯ জন বাদ দিয়েছে। এটাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্পিরিটের বরখেলাপ বলে দাবি করছেন অনেকেই।

সার্বিক বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো: মোখলেস উর রহমানের দপ্তরে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence