‘চাকরি ও টাকার প্রলোভন দিয়ে’ স্ত্রীর জন্য অনাত্মীয়র কিডনি নিয়েছেন ভিসি লুৎফুল

অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান ও বাকৃবি লোগো
অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান ও বাকৃবি লোগো  © টিডিসি ফটো

২০১৯ সালের ৩০ মে থেকে পরবর্তী চার বছরের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন উচ্চশিক্ষালয়টির তৎকালীন কৃষি অনুষদের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বোচ্চ প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করার এ সময়কালে নিজ ক্যাম্পাসে চাকরি ও নগদ পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার প্রলোভনে বহিরাগত এক যুবকের কাছ থেকে নিজের অসুস্থ স্ত্রীর জন্য কিডনি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

তবে কিডনি নেওয়ার পর ওই যুবককে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান, এমনটাই দাবি ভুক্তভোগীর। পরবর্তীতে চাকরি ও অর্থের জন্য তার কাছে গেলে পুলিশে দেয়াসহ নানা হয়রানি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই যুবক।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও নগদ অর্থ— কোনোটিই কিছু না পেয়ে ওই যুবক কিছুদিন বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার বিচার চান শেখ সোহেল রানা নামের ওই যুবক।

“সোহেল রানার কিডনি আমার স্ত্রীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হলেও স্ত্রী সেটি চাননি। তিনি কোনো ‘ব্রেইন ডেড’ মানুষের কিডনি চেয়েছিলেন। তাছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপনের সব আয়োজন অ্যাপোলো হসপিটাল কর্তৃপক্ষই সম্পন্ন করেছে। চাকরি ও আর্থিক চুক্তির বিষয়ে তার (সোহেল রানা) সাথে আমার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না- ড. লুৎফুল হাসান, সাবেক ভিসি, বাকৃবি

বাগেরহাটের পি.সি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা এই যুবকের দাবি, বর্তমানে তিনি অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারছেন না। তাই তার ওই টাকাগুলো দরকার এবং তাকে একটি চাকরিও দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি। এদিকে, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং আইনানুগ বিচার দাবি ও ক্ষতিগ্রস্ত যুবকের পুনর্বাসনের কথা বলছেন দেশের শিক্ষাবিদ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিসি অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান কিডনি নেওয়ার জন্য ওই যুবককে নিজ খরচ ও ব্যবস্থাপনায় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এরপর সেখানে প্রায় পাঁচ মাস থাকার পর অপারেশনের মাধ্যমে ওই যুবকের কিডনি ভিসির স্ত্রীর দেহে প্রতিস্থাপনের পর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

“যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং যার কিডনি নেওয়া হয়েছে আদালতের মাধ্যমে তাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছে কি-না, এটিও খতিয়ে দেখতে হবে-ড. ইফতেখারুজ্জামান, টিআইবি

ঘটনাটি ২০২২ সালের দিকের। সে সময় অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসানের সহধর্মিনীর কিডনি অচল হয়ে পড়লে তাঁকে চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁর একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ মিল থাকায় ভিসির স্ত্রীকে শেখ সোহেল রানার 'খালা পরিচয়ে' কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক পার্থ প্রতিম বিশ্বাসের সহযোগী চিকিৎসক ডা. মাহবুবের মধ্যস্ততায় অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসানের সঙ্গে পরিচয় হয় সোহেল রানার। এরপর মাত্র দু’দিনের মধ্যে তার পাসপোর্ট তৈরি করা, ভিসা এবং অন্যান্য সকল সহযোগিতাই করেছেন অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান।

ভুক্তভোগী শেখ সোহেল রানা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে আমি আর্থিক সংকটে পড়ি। তখন ঢাকা মেডিকেলে কলেজে আমার সাথে ডা. মাহবুবের সাথে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমেই আমার সাথে ভিসি ড. লুৎফুল হাসানের সাথে পরিচয় হয় এবং আমার একটি কিডনি-দানের বিনিময়ে সরকারি চাকরি ও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বাকৃবির ২৪তম ভিসি হিসেবে চার বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৯ সালের ৩০ মে। এরপর তিনি চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালের ৩০ মে ভিসি হিসেবে তার দায়িত্ব শেষ হয়। এর আগে তিনি দ্বিতীয় দফায় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের সভাপতিও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। 

‘‘সে কথা অনুযায়ী ড. লুৎফুল হাসান আমাকে ভারতে নিয়ে যান এবং সেখানে পাঁচ মাস থাকতে হয়। তখন আমার একটি কিডনি তার স্ত্রী’র শরীরে স্থাপন করা হয় এবং এরপর তিনি সুস্থ হন, আমিও তখন একটু সুস্থ ছিলাম। এখন আমি অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারছি না। আমি অনেক কষ্টে আছি; আমার চিকিৎসা দরকার। আমি এখন এ ঘটনার বিচার চাই। আমি আমার টাকা চাই এবং আমাকে একটি চাকরি দেওয়া হোক’’- বলছিলেন শেখ সোহেল রানা।

তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে আসার পর আমি ড. লুৎফুল হাসানের কাছে টাকা এবং আমাকে চাকরি দিতে বলি। তখন তিনি আমাকে কখনো ২ হাজার, কখনো ২ হাজার ৫শ’ এরকম করে টাকা দেন এবং এক পর্যায়ে আমাকে তাড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে আমি তাঁর কাছে গেলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেন। এ পর্যন্ত  বনানী থানা পুলিশ আমাকে তিনবার ধরে নিয়ে নিয়েছে, হয়রানি করেছে।

আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে আমি আর্থিক সংকটে পড়ি। তখন ঢাকা মেডিকেলে কলেজে আমার সাথে ডা. মাহবুবের সাথে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমেই আমার সাথে ভিসি ড. লুৎফুল হাসানের সাথে পরিচয় হয় এবং আমার একটি কিডনি-দানের বিনিময়ে সরকারি চাকরি ও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন-শেখ সোহেল রানা, ভুক্তভোগী যুবক

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসানের সাথে। তিনি সব অভিযোগ নাকচ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি সোহেল রানাকে কোথাও নিয়ে যাইনি এবং তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ বা চুক্তি নেই বা হয়নি। আমার স্ত্রী অসুস্থ হলে আমরা ভারতের অ্যাপোলো হসপিটালে যাই। তখন সেখানে তার কিডনি ডায়ালাইসিস চলা অবস্থায় চিকিৎসকদের পরামর্শে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।

অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান দাবি করেন, সোহেল রানার কিডনি আমার স্ত্রীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হলেও  তিনি সেটি চাননি। তিনি কোনো ‘ব্রেইন ডেড’ মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের পক্ষে ছিলেন।

এছাড়াও কিডনি প্রতিস্থাপনের পূর্বে ড. লুৎফুল হাসানের সাথে সোহেল রানার কখনও দেখা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের সব আয়োজন অ্যাপোলো হসপিটাল কর্তৃপক্ষই সম্পন্ন করেছে। এছাড়াও চাকরি ও আর্থিক চুক্তির বিষয়েও তার সাথে আমার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। এর বাইরে কাউকে চাকরি দেওয়ার কথা আমি কখনও বলিনি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাহবুবুর রহমানের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সোহেল রানা নামের কাউকে আমি চিনি না। তার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। সে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমি বিষয়টি নিয়ে শাহবাগ থানায় জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করেছি। সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে। হুমকি দিচ্ছে। আমি বিষয়টি নিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

বিষয়টি অবগত হয়ে অনেকটা হতাশা প্রকাশ করেন দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। এই শিক্ষাবিদ বলেন, কাউকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার ঘটনা দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। এ ধরনের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে এসব বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

“সোহেল রানা নামের কাউকে আমি চিনি না। তার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। সে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমি বিষয়টি নিয়ে শাহবাগ থানায় জিডি করেছি-মাহবুবুর রহমান, চিকিৎসক, ঢামেক হাসপাতাল

কাউকে জোর করে বা কারও কাছ থেকে বলপ্রয়োগপূর্বক কোনো ধরনের সুবিধা আদায় করা ঘোরতর অপরাধ বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, উপাচার্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুবিধা আদায় করেছেন এবং কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির জন্য তো এটি আরও উৎকট ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমি মনে করি, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং যার কিডনি নেওয়া হয়েছে আদালতের মাধ্যমে তাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছে কি-না, এটিও খতিয়ে দেখতে হবে।

যেহেতু প্রতারণাসহ বহুমাত্রিক অবৈধ প্রক্রিয়ায় দেশের বাইরে অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন করা হয়েছে সেজন্য এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার মতো আলামতও রয়েছে বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।


সর্বশেষ সংবাদ