ছাত্রদের সিটে তুলতে হলেই প্রাধ্যক্ষের রাত্রিযাপন, উঠলেন ১৮ জন

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল  © টিডিসি ফটো

রুমে রুমে অভিযান চালিয়ে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের নামিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের সিটে তুলতে হলেই রাত্রিযাপন করলেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন। শুক্রবার (১ জুলাই) রাতভর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে রাত্রিযাপন করেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্বঘোষণা দিয়ে হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের নামিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের তুলে দিতে শুক্রবার বিকেল ৪টা থেকে অভিযানে নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল প্রশাসন। রাত সাড়ে ৮টা থেকে হলের রুমে রুমে অভিযান চালানো শুরু করেন তারা। 

বিভিন্ন ধাপে হওয়া এ অভিযান চলে ভোররাত পর্যন্ত। অভিযান চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন ও ছাত্রলীগের মধ্যে চলে দফায় দফায় বৈঠক। ফলে হলের অনাবাসিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নামিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের সিটে তুলতে বেগ পেতে হয় প্রাশাসনকে। তবে শেষ পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ১৮ জন আবাসিক শিক্ষার্থীকে হলে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তারা।

হল সূত্রে জানা যায়, করোনার দীর্ঘ ছুটিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে ৯৪টি আসন খালি থাকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদনপত্র আহ্বান করে হল প্রশাসন। পরে ভাইভার মাধ্যমে একাডেমিক ফলাফলসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে ৬৬ জন শিক্ষার্থীকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়। যারমধ্যে সব মিলে ৪০ জন সিটে উঠলেও বাকি ৫৪টি সিট রয়েছে অনবাসিকদের দখলে।

ছাত্রলীগের অবস্থান-পিছুটানে প্রাধ্যক্ষের বুমেরাং 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলকে অনাবাসিক শিক্ষার্থী মুক্ত করার অভিযানে নামলে শুক্রবার বিকেলে প্রাধ্যক্ষ অফিসের সামনে কিছু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেখা যায়। সে সময় হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, প্রাধ্যক্ষ হল থেকে ছাত্রলীগ নামিয়ে বিএনপি-জামায়াত এজেন্ডা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। তিনি সিট থেকে ছাত্রলীগ নামানোর মিশনে নেমেছেন। কিন্তু তা হতে দেয়া হবে না। হল থেকে কোনো ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নামাতে হলে, আগে আমাকে এই হল থেকে বহিষ্কার করে ছত্রলীগকে নামাতে হবে। 

আরও পড়ুন: জবি ছাত্রলীগ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ‘কুপ্রস্তাব’ অভিযোগ নারী নেত্রীর

কিন্তু রাত প্রায় ১১টার দিকে হলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু আসলে অবস্থা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ফের দফায় দফায় বৈঠক বসে। যা চলতে থাকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত। এরমধ্যে ছাত্রলীগের চাপে বরাদ্দ কক্ষে তুলেও ফের কিছু শিক্ষার্থীকে নামিয়ে ভিন্ন কক্ষে তুলতে বাধ্য হয় হল প্রশাসন। তবে শেষ পর্যন্ত ১৮ জন আবাসিক শিক্ষার্থীকে সিটে তুলতে সক্ষম হয়েছে প্রশাসন। 

সিট পেলেও শিক্ষার্থীদের শঙ্কা কাটেনি

প্রাধ্যক্ষের হস্তক্ষেপে আবাসিক শিক্ষার্থীদের সিটে তুলে দেয়া হলেও ছাত্রলীগের চাপের মুখে কয়েক ঘন্টা পরেই দুই জনকে সিট থেকে নামিয়ে আনে হল প্রশাসন। প্রাধ্যক্ষ কক্ষে চলে দফায় দফায় বৈঠক। রাত গভীর হয়, কিন্তু সমাধান আর হয় না। ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুল ইসলামকে প্রথম ব্লকের ১৪৫ নম্বর কক্ষ থেকে নামিয়ে তৃতীয় ব্লকের ৪২১ নম্বর কক্ষে উঠানো হয়। ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী স্বাধীন আহমেদকে ২৫৪ নম্বর কক্ষ থেকে ১৫৬ নম্বর কক্ষে উঠানো হয়। 

জানা গেছে, ইনফরমেশন সাইন্স এন্ড লাইব্রেরী ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগ ইসলামকে ৩৬০ নম্বর কক্ষে তুলে দেয়া হলেও সেই কক্ষ থেকে নামেনি ২০১৯-২০ সেশনের অনাবাসিক এক ছাত্রলীগ কর্মী। একই সিটে ভাগাভাগি করে থাকতে হচ্ছে তাদের। একই ঘটনা ঘটেছে একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থীর সিটে। তাছাড়া সিট না পেয়ে পুলিশ থাকার কক্ষে চারজনকে উঠানো হয়েছে। তাই এমন অবস্থায় সিটে অবস্থান করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে রাত্রীযাপন করে আবাসিক শিক্ষার্থীদের সিটে তুলে দেয়ায় প্রশাসনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বৈধভাবে সিটে উঠতে পেরে উচ্ছ্বসিত তারা। 

অভিযান শেষে প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সিট কেন্দ্রিক সমস্যাটা হলের সার্বিক কাজকে ব্যাহত করছে। যার জন্য হলের অন্য উন্নয়ন মূলক কাজে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই অনাবাসিক মুক্ত হল নিশ্চিত করে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার্থে কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ আমরা চাই, বৈধভাবে আবাসিক শিক্ষার্থীরাই হলে থাকুক। তাই এই রাত জেগে এই কার্যক্রম। যাহোক অবশেষে ১৮ জন আবাসিক শিক্ষার্থীকে সিটে তোলা হয়েছে। যার মাধ্যমে একটি শুভ সূচনা হলো।

সিটে তোলা শিক্ষার্থীদের শঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাধ্যক্ষ বলেন, যাদের সিটে তোলা হয়েছে, তারা সেই সিটে শেষ পর্যন্ত থাকবে। যদি কেউ বিশৃঙ্খলা করে, তবে প্রশাসনকে অবিহিত করার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এমনকি কোন আবাসিক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে তাকে হল থেকে বহিস্কার করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ফেরদৌস মহল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় সমন্বিতভাবে কাজ করছে প্রাধ্যক্ষ পরিষদ। আমরা চাই, হলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদে থেকে পড়াশোনা করুক। কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা পরিবেশ সৃষ্টি না হোক। একই সাথে বৈধভাবে আবাসিক শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করুন, সেই লক্ষ্যে সমন্বিত কাজ করছে প্রশাসন।

এরআগে, গত ২৩ জুন হল শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে অনাবাসিক, বহিরাগত ও অন্য হলের শিক্ষার্থীদের ২৯ জুনের মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। কোনো শিক্ষার্থী তার সমস্যার বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে হল প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ২৮ জুনের মধ্যে অভিভাবকসহ হল প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে শর্ত অনুযায়ী কেউ দেখা না করলে কিংবা অনাবাসিক কোনো শিক্ষার্থী নেমে না গেলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুশিয়ারি দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, বিগত কয়েক মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য, সিট দখল, হলে শিক্ষার্থীকে মারধর ও হল গেটে তালা দেয়ার মতো অনেক অভিযোগ রয়েছে। যার ফলে হলগুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিবাদ জানিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। 

তাছাড়া গত ২৪ জুন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলে মধ্যরাতে আবাসিক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় একজনকে সাময়িক বহিষ্কার ও অবৈধভাবে হলে থেকেও বিশৃঙ্খলার দায়ে দুইজনকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হলগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। ফলে হলেগুলোতে কোন ধরণের বিশৃঙ্খলার প্রমাণ পেলে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।


সর্বশেষ সংবাদ