ভুল তথ্য দিয়ে চাকরি স্থায়ী করার অভিযোগ ঢাবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে

অভিযোগকারী ড. জাহাঙ্গীর আলম ও অভিযুক্ত ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন
অভিযোগকারী ড. জাহাঙ্গীর আলম ও অভিযুক্ত ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন  © সংগৃহীত

জার্নালে ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেখা প্রকাশিত হয়েছে’ এমন ভুল তথ্য দিয়ে পদোন্নতি ও চাকরি স্থায়ীকরণের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে।

সময়মতো লেখা প্রকাশ করতে না পেরে সংশ্লিষ্ট জার্নালের এডিটরের সঙ্গে যোগসাজশে ‘অনৈতিক পন্থায় ভুয়া তারিখ’ দেখিয়ে চাকরি স্থায়ী ও বিভাগে জ্যেষ্ঠতা ধরে রাখার অভিযোগ তুলেছেন নিজ বিভাগে শিক্ষক ও কই বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বরাবর এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। অভিযোগপত্রে সঙ্গে তিনি একাধিক প্রমাণাদিও যুক্ত করেছেন। অভিযুক্ত শিক্ষক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন।

ঢাবিতে চাকরিতে স্থায়ীকরণের নিয়ম হলো, প্রার্থীর পদোন্নতির ঠিক এক বছরের মধ্যে ডিজিটাল অবজেক্ট আইডেন্টিফায়ার (ডিওআই)-সংবলিত জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে হবে। জার্নালের ইস্যু, ভলিউম, মাস মুখ্য নয়। জার্নাল প্রকাশিত হতে হবে ওই নির্দিষ্ট প্রবেশন সময়ের মধ্যে। কিন্তু ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পদোন্নতি প্রাপ্ত হন ড. মামুন এবং ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখের মধ্যে প্রকাশিত প্রবন্ধ জমা দেওয়ার কথা ছিল তার।

আরো পড়ুন: সাবেক সাত উপাচার্যসহ ২০১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা

এমনকি জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের তিনজন শিক্ষক একই দিনে সহযোগী অধ্যাপক হন এবং একই তারিখে সবার প্রবেশন দেওয়া হয়। ঢাবির চাকরির নিয়ম অনুযায়ী, চাকরি কনফার্মেশনের নির্দিষ্ট সময়ে যদি জ্যেষ্ঠ কেউ প্রবন্ধ প্রকাশনা করতে না পারেন এবং অন্যরা করে ফেলেন, তবে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অন্যদের থেকে জুনিয়র হয়ে যাবেন।

এ ছাড়া ২০২৩ সালের ২৯ মে স্থায়ীকরণ কমিটির সভা হয় এবং ড. মামুনের প্রবন্ধ বিলম্বে প্রকাশিত হওয়ায় (সোশ্যাল সায়েন্স রিভিওয়ের একটি প্রবন্ধের অ্যাকসেপট্যান্স লেটার জমা দেওয়া হয়) তাকে বাকি দুজন থেকে জুনিয়র করা হয়।

এ বিষয়টি জেনে ড. মামুন ‘জার্নাল অব গভর্ন্যান্স, সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’র এডিটরের যোগসাজশে একটি প্রবন্ধ প্রথমে অনলাইনে প্রকাশ করেন এবং সেখানে প্রকাশের তারিখ দেখান ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি এবং ওই ভুয়া তথ্য দিয়ে নতুন করে এ প্রবন্ধ জমা দিয়ে তিনি চাকরিতে স্থায়ী হন ও অন্য দুই শিক্ষকের থেকে জ্যেষ্ঠ হন।

কিন্তু ঢাবিতে স্থায়ীকরণের সময় ডিওআই-সংবলিত প্রবন্ধ চাওয়া হয়, যেন কেউ প্রবন্ধ প্রকাশের তারিখ নিয়ে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন বা জালিয়াতি করতে না পারেন।

আরো পড়ুন: আওয়ামী লীগকে ফেরানোর খায়েশ বিপজ্জনক: উপদেষ্টা আসিফ

এ বিষয়ে অভিযোগকারী জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সুস্পষ্টভাবে জার্নাল প্রকাশের তারিখ জালিয়াতি হয়েছে। ড. মামুনের এই প্রবন্ধ যদি ২০২৩-এর ১ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়ে থাকে, তবে ২০২৩-এর ২৯ মে স্থায়ীকরণের আগে তিনি এই প্রবন্ধ জমা দিলেও কেন চাকরি স্থায়ীকরণ হয়নি? কারণ তখন ওই ডিওআই দিয়ে অনলাইনে প্রকাশিতই হয়নি, যা মেটা ডেটা দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। সে এ প্রবন্ধে রেজিস্ট্রেশন করেছেই ২০২৩-এর ১ জুন। তাই এর আগে অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ড. মামুন ২০২৩-এর ২৯ মে স্থায়ীকরণ সভায় যখন দেখলেন, প্রকাশিত প্রবন্ধ জমা দিতে পারেননি এবং জুনিয়র হয়ে গেলেন, তখন তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিলেন। ওই প্রবন্ধের মেটা ডেটা চেক করে দেখা যায়, তিনি ডিওআইয়ের জন্য আবেদন করেছেন ২০২৩-এর জুন মাসের ১ তারিখ এবং সেদিনই তার প্রবন্ধ অনলাইনে আসে।’

ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘অর্থাৎ তার এই লেখা অনলাইনে তার স্থায়ীকরণ শর্তানুযায়ী ২০২৩-এর ২২ ফেব্রুয়ারি প্রায় সোয়া তিন মাস পর প্রকাশিত হয়। ওই জার্নালের হার্ড কপিতেও এই একই ডিওআই নম্বর দেওয়া আছে। এর অর্থ হলো ২০২৩-এর ১ জুন ডিওআই নম্বর পাওয়ার পরই হার্ডকপি প্রিন্ট করা হয়েছে। এর আগে ডিওআই-সংবলিত জার্নাল প্রিন্ট করা অসম্ভব।’

আরো পড়ুন: হত্যা-লুটপাটে জড়িত নয়, এমন নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাধা নেই: রিজভী

তিনি বলেন, ‘কারণ হার্ডকপির পেজ নম্বর (৩১-৫৪) ও অনলাইন কপির পেজ নম্বরে (১-১৯) গরমিল আছে। এর মানে হলো, ওই জার্নালের অনলাইন ভার্সন বা হার্ডকপি দুটোই জুন মাসের ১ তারিখ বা এরপর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং বাকি দুজন শিক্ষক যদি নির্দিষ্ট সময়ে লেখা প্রকাশ করে থাকেন, তবে ড. মামুন তাদের চেয়ে জুনিয়র হতে বাধ্য, এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ড. মামুনের এ প্রবন্ধের অনলাইন ভার্সন ও হার্ডকপির পৃষ্ঠার নাম্বারিংয়ে গরমিল রয়েছে। এর একটিই ব্যাখ্যা দাঁড়ায় যে ড. মামুন ব্যক্তিগতভাবে তার লেখার ডিওআই নিয়েছেন এবং পরে তিনি জার্নালে জমা দিয়েছেন এবং অন্য প্রবন্ধের ডিওআই করে দিয়েছেন। একই জার্নাল এবং এর প্রোডাকশন বিভাগ ডিওআই রেজিস্ট্রেশনের কাজ করলে তার প্রবন্ধের সিরিয়াল ও পৃষ্ঠা নম্বর ঠিক থাকত।’

ঢাবির জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. দিলরুবা শারমিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এখন জেনেছি, যেহেতু ড. জাহাঙ্গীর আলম ড. মামুনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন, বিষয়টি ঢাবি প্রশাসন দেখবে।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক ঢাবির জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন,‌ ‘আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগটি মিথ্যা। যিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তিনি যখন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হন, পদোন্নতি বিষয়ে একটি আর্টিকেল জমা দিতে হয়। অগ্রহণযোগ্য জার্নাল লেখার কারণে তাকে কিন্তু শাস্তিস্বরূপ ২টি আর্টিকেল জমা দিতে হয়েছে। উনি আওয়ামীপন্থি শিক্ষক, ৪ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল, শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয় ও তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে উনাকে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখে ঢাবি প্রশাসন। পরবর্তীতে তাকে অ্যাকাডেমিক কাজে যুক্ত করা হলেও, চেয়ারম্যানশিপ থেকে তাকে দূরে রাখা হয়।

এ ছাড়াও পরীক্ষা ছাড়াই তিন ছাত্রলীগ নেতাকে প্রফেশনাল মাস্টার্স প্রোগ্রামে অবৈধভাবে ভর্তি করার অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এসব কারণে সে মনে করে তাকে বরখাস্ত করার পেছনে আমি আছি। যে কারণে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করছেন। তাছাড়া ২০২৩ সালের  জুলাই মাসে আইন হয়। আর আমার পদোন্নতি ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল। আমার ক্ষেত্রে করা এ অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

উনি নীলদল যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে একবার নির্বাচন করেছিলেন। এসব ঘটনায় উনি মনে করে আমি জড়িত, কিন্তু তা একদম মিথ্যা কথা। আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও অন্যতম শিক্ষক। এটার কারণে আমার বিরুদ্ধে আর্টিকেলের বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছেন উনি। 

আমার আর্টিকেলটির বিষয়ে বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএনডি কমিটি করা হয়, সে কমিটিতেও উনি সিএনডির মেম্বার ছিলেন। তাহলে কেন আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। একজন লেখক শুধু লেখা জমা দেবে, তবে ডিওআই নম্বর কর্তৃপক্ষ দেয়। ডিওআই নম্বর কোন মাসে নিয়েছে এটা কর্তৃপক্ষের বিষয়। আমার আর্টিকেল যখন অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। হার্ডকপি অনলাইনে পাবলিশ হওয়া এক জিনিস ও ডিওআন থাকা না থাক অন্য জিনিস। এখানে কোন রকম তথ্য গোপন করার সুযোগ নেই।


সর্বশেষ সংবাদ