কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে যে বিষয়গুলো জানা জরুরি

শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী  © ফাইল ফটো

সম্প্রতি এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আগামী ১০ আগস্ট থেকে শুরু হবে কলেজে একাদশ শ্রেণির ভর্তি প্রক্রিয়া। এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কে কোথায় ভর্তি হবেন, কোন গ্রুপে ভর্তি হবেন তা এখনই  নির্বাচন করা জরুরি। এই সময়ের সামান্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত বয়ে আনতে ক্যারিয়ার জীবনে বিপর্যয়। তাই সতর্ক ও সাবধান হন অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন এবং আপনার  প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পড়ার প্রিয় বিষয় সমূহ ।

পছন্দের তালিকায় কোন কলেজ রাখবেন এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীর জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভালো কলেজে ভর্তির আসন পূর্ণ হয়ে যাবে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী দিয়েই। ফলে শিক্ষার্থীদের অন্য কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগও খুঁজতে হবে। অভিভাবকদের ধারণা ভালো কলেজে ভর্তি হলেই ভালো ফলাফল করা যায় তাই যে করেই হোক নামিদামি কলেজেই  ভর্তি হতে হবে। এটি একটি বড় ধরনের ভুল ধারণা। ভালো কলেজের শিক্ষার্থীরাও অকৃতকার্য হয় আবার এসএসসির চেয়ে এইচএসসিতে অনেক খারাপ রেজাল্ট করেছে এমন নজির অনেক রয়েছে । স্বনামধন্য কলেজগুলোতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় তবুও কেন তাঁরা  অকৃতকার্য হবে? অথচ এমন অনেক কলেজ রয়েছে যেগুলোতে কেউ অকৃতকার্য হয়নি। আবার অনেক কলেজে এসএসসি তে এ+ পেয়েছিল, এইচএসসিতে সে এ+ পায়নি। আবার উল্টো ঘটনাও  অনেক প্রতিষ্ঠানে ঘটেছে। 

ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা চায় নামীদামী কিংবা যেসব কলেজের ফলাফল বরাবরই ভালো এবং দেশ জুড়ে এর  নাম আছে এমন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে। আবার কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা চায় বেশ নাম করা বেসরকারি কলেজে ভর্তি হতে, যেখান থেকে তারা আধুনিক বিশ্বের খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারবে-এমন  ইচ্ছে নিয়ে। কিছু শিক্ষার্থী চায় এমন কোন কলেজে ভর্তি হতে যেখান থেকে সে মোটামুটি উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতে পারবে। এসবের বাইরে গিয়ে আরেক রকমের শিক্ষার্থী আছে যারা কোন রকমের কোন কলেজের  বারান্দায় পা রাখতে পারলেই খুশি, সে হোক গাঁয়ের বা পাড়ার কলেজ বা শহরের দামি কলেজ। ইচ্ছে জনে জনে ভিন্ন। যে যেমন কলেজেই ভর্তি হতে চায় না কেন, শেষ পর্যন্ত একটু  কম পছন্দের বা অপছন্দের কলেজেই ভর্তি  হতে হয় সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের। ইচ্ছে যেমন জনে জনে ভিন্ন তেমনই সকলের মেধার মান এক রকম নয়।

কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত 
১. এসএসসির ফলাফল
২.কলেজের মান 
৩.ল্যাবরেটরির সম্পর্কে ধারনা 
৪.অর্থ নির্বাহ 
৫.দূরত্ব 
৬.সিদ্ধান্ত 

ফলাফল: এসএসসির ফলাফলের দ্বারাই অনেকটা নির্ধারণ হয়ে যায় ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর একাদশ শ্রেণীতে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারবে,  কোন কোন প্রতিষ্ঠানে  আবেদন করতে পারবে না। কলেজগুলোরও চাহিদা থাকে যে, কোন মানের ফলাফলের নিচে শিক্ষার্থী তাঁরা নিবে বা নিবে না।

কলেজের মান: কলেজের মান বিচারের জন্য কখনোই বড় মাপের গবেষণার প্রয়োজন নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত অবস্থা, লোকেশন, পরিচিতি এবং অনলাইন থেকে বিগত কয়েক বছরের ফলাফল ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হওয়াই যথেষ্ট। এর চেয়ে গভীরভাবে বা ভিতরে গিয়ে কখনোই প্রতিষ্ঠানে মান যাচাই করা সম্ভব নয়। তাছাড়া  সময়ও কম, প্রাথমিকভাবে শুধু ধারণা নেওয়াই যথেষ্ট। শুধু নামে নয় ও দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

অর্থ নির্বাহ: উচ্চবিত্তদের জন্য এটি ডাল ভাতের মতো মনে হলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের জন্য কঠিন। তাদের ক্ষেত্রে মাথায় যে বিষয়টি রাখতে হয় সেটি আর্থিক অবস্থা। যেকোনো কিছুর জন্যই অর্থ সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেমন খরচ হয় কিংবা বর্তমান সময়ে যেহেতু প্রাইভেট পড়ার প্রবণতা রয়েছে, কলেজের কাছাকাছি বাসা ভাড়া করে থাকতে হবে কিনা এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু ভাবা উচিত, খোঁজ নেওয়া উচিত যে, কোথায় ভর্তি হলে বা করালে অর্থের পরিমাণ কিছুটা হলেও কম লাগবে। আবার অর্থ থাকলেই যে ব্যয় করতে হবে সেটিরও বিশেষ কোন মানে নেই।

দূরত্ব: বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব নিয়ে ভাবা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতটা সম্ভব বাড়ির কাছাকাছি হলেই ভালো হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাস এসএসসির সিলেবাসের থেকে অনেক অনেক গুণ বড় এবং সেই তুলনায় সময় অনেক কম পাওয়া যায় যা বাস্তবে দেড় বছরেরও কম। এই অল্প সময়ের মধ্যে তোমার  উচিত বেশিরভাগ সময় পড়ার কাজে ব্যয় করা। তোমার কলেজ যদি বাসা থেকে অনেক দূরে হয় তাহলে যাতায়াতে অনেক সময় নষ্ট হবে। আর দিন শেষে  তুমি ক্লান্ত হয়ে যাবে। তাই পড়ালেখায় মন  বসানো এবং সামনে ভালো  করা তোমার জন্য হয়ে যাবে অনেক কষ্টের বিষয়।যাতায়াতে  যে সময় নষ্ট হবে সেই সময়টাতে পড়াশোনা মন দিলে নিশ্চিত ভালো রেজাল্ট হবে ইনশাল্লাহ।

ল্যাবরেটরির অবস্থা সম্পর্কে জানা: বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এইচএসসি পরীক্ষার ব্যবহারিক অংশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে খুব কম কলেজেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন ল্যাবরেটরি দেখা যায়। অনেক কলেজে ল্যাবরেটরির থাকলেও ভালো প্রদর্শক নেই, প্রদর্শক  না থাকায় খুব বেশি শেখার সুযোগ থাকে না,যা পাবলিক পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট করতে বাধাগ্রস্ত করে। তাই যে কলেজগুলোতে তোমার লিস্টের উপরের দিকে  দিয়েছো ঐ সমস্ত কলেজের ল্যাবরেটরি অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে রাখা উচিৎ। 

কলেজ নির্বাচন: এসএসসির পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কলেজ নির্বাচন করা, কেননা পরবর্তী জীবনে ক্যারিয়ারের ভীত এখানেই রচিত হয়। তাই এই সময়টা সিদ্ধান্ত নিতে হয় অনেক ভেবে,চিন্তে এবং সতর্কতার সাথে। নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণ থাকা জরুরী। তবে শুধু নিজের ইচ্ছা বা আগ্রহকে প্রাধান্য দিলেই অনেক সময় লক্ষ্য নির্ধারণ সঠিক হয় না। তুমি কত জিপিএ পেয়েছ এবং কোন বিভাগে পড়তে  চাও তাঁর উপর মূলত নির্ভর করবে তোমার কলেজ নির্বাচন। যারা জিপিএ-৫ তাদের প্রতিযোগিতা বেশি। এমন কোন কলেজেও সহজেই খাপ খাওয়াতে পারবে কিন্তু কারো যদি গ্রেড পয়েন্ট কম থাকে তাহলে তার উচিত একটু মাঝারি মানের কলেজ  নির্বাচন করা।

কলেজের পরিবেশটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমন অনেক কলেজ আছে যেখানে হয়তো পড়ালেখার ভালো, রেজাল্ট  ভালো কিন্তু পরিবেশ ভালো নয় অভিভাবকদের উচিত এ ধরনের কলেজ এড়িয়ে যাওয়া।কারণ  কলেজের সময়টায় ছেলে- মেয়েদের মধ্যে একটু স্বাধীন চেতা মনোভাব  চলে আসে, তখন তাঁরা কার  সাথে মিশছে,  কেমন পরিবেশে পড়ছে  এসব দিক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের দেশে এখনো কোনো একটা কলেজ ভালো বা খারাপ এটি নির্বাচন করা হয় বেশিরভাগ সময়েই কলেজটির পূর্ববর্তী বছরগুলোর রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে। তবে তোমার উচিত হবে  কলেজের পূর্ববর্তী বছরের পাশের হার কেমন, জিপিএ-৫ কতজন  পেয়েছে এ সম্পর্কে অবহিত হয়ে কলেজ নির্বাচন ও ভর্তি হওয়া।

অনলাইনে কলেজ নির্বাচনে তোমাকে একটি  লিস্ট তৈরি করতে হবে সব থেকে বেশি পছন্দের কলেজের স্থান হবে সবার উপরে এবং পর্যায়ক্রমে কম পছন্দের কলেজগুলোর স্থান  নিচে নিচে   সাজাতে হবে 

বিভাগ নির্বাচন: অনেকেই জিজ্ঞেস করেন এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ছিলাম এখন আমি মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তি চাচ্ছি। এটা কি সম্ভব? হ্যাঁ এটা অবশ্যই সম্ভব। তবে তার আগে নিজের স্বপ্ন ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন। আপনার স্বপ্ন দেখার উপর নির্ভর করবে আপনি কি হতে চান। একেই  এসএসসিতে যেই  বিভাগের ছিল সেই বিভাগেই আবার পড়তে চায় কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসির  সিলেবাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাই বিভাগ  নির্বাচনে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।আবার  কেউ কেউ আছেন এসএসসিতে হয়তো বিজ্ঞান বিভাগে ভালো ফলাফল করতে পারেননি তাই বিভাগ পরিবর্তন করে ব্যবসায় শিক্ষা নিতে  চাচ্ছেন অথবা এসএসসির সময় ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পরে মানবিক  বিভাগে ভর্তি হতে চান  এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেও বড় ভাই-বোনদের বা  অভিভাবকদের  সাথে আলাপ করে বুঝে নিতে হবে বিভাগ পরিবর্তন করা  ঠিক হবে কিনা। আর  যদি  বিভাগ পরিবর্তন করতেই  হয় তাহলে সেই বিভাগের বিষয়গুলো সম্পর্কে আগে থেকে একটু ধারণা নিয়ে রাখা ভালো হবে। বিভাগ পরিবর্তনে আরেকটি বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত সেটি হচ্ছে আর্থিক সামর্থ্য। বিজ্ঞান বিভাগে নিয়ে পড়তে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাইভেট বা কোচিং করতে হয়। প্রাইভেট বা কোচিং করার আর্থিক সামর্থ্য আছে কিনা ভেবে দেখুন। তারপর ভেবে দেখুন আপনি ফল ভালো করতে পারবেন  কিসে? যদি মানবিকে ভালো ফল করতে বলে আপনার আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে অবশ্যই মানবিক বিভাগ নিন।এক কথায়  মেধা যোগ্যতা ভালোলাগা আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী স্বপ্ন দেখুন।

বিষয় নির্বাচন: বিভাগ নির্বাচনের পর যে ব্যাপারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল বিষয় নির্বাচন করা। বিভাগ ভিত্তিক দুটি বিষয় আবশ্যিক থাকে তারপর একটি ঐচ্ছিক  এবং অপরটি চতুর্থ বিষয়ে হিসেবে নির্বাচন করতে হয়। যে যেটা ভালো বুঝবে তার জন্য সেই বিষয়টি নির্বাচন করা উচিত। এক্ষেত্রে অন্য কারো কথা শুনে বা বন্ধুরা নিচ্ছে  বলে নিজে ভালো না লাগলেও সেই বিষয় নির্বাচন করা উচিত নয়। কোন  বিষয়ে ভালো মার্কস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেই দিকেও খেয়াল রেখে বিষয় নির্বাচন করতে হবে।

সিদ্ধান্ত: কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এককভাবে শিক্ষার্থীকে বড় করে না বরং উপযুক্ত সুবিধা ও শিক্ষার্থীরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বড় করে তুলতে  পারে। হতে পারে আজকের একটি মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিচু মানের   একটি কলেজও মাথা উঁচু  করে একদিন বলবে, "আমরাও সামর্থ্য আছে"। এর উল্টোটাও  কিন্তু হতে পারে বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের জন্যও।

সিদ্ধান্ত প্রত্যেকের নিজের ও পরিবারের তবে, হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। সময় নিয়ে পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করে কলেজের  পছন্দক্রম সাজানো উচিত।উপরের যে  বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। সবার জন্য দোয়াসহ।  শুভকামনা রইল

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, তেঁতুলঝোড়া কলেজ, সাভার, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ