পুলিশ ক্যাডার সজীব বললেন— ‘মায়ের মুখটাই আমার শক্তি’

মো. সজীব মিয়া
মো. সজীব মিয়া  © টিডিসি ফটো

৪৩তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সজীব মিয়া। একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবার মৃত্যুর পর মাকে একা রেখে দেশত্যাগের কথা আর ভাবতে পারেননি। দেশেই ভালো কিছু করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। চাকরির পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন পেশার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন সজীব। স্বভাবতই একসঙ্গে টিউশন পড়ানো ও বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়াটা তার কাছে চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে বহু শেষ পর্যন্ত তিনি পেরেছেন এবং সফল হয়েছেন। সম্প্রতি সজীব নিজের সাফল্যের গল্প নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন। তার কথাগুলো শুনেছেন— সিয়াম হাসান।

সজীবের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। বাবার নাম মো. লাল মিয়া। তিনি ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। সজীবরা ছয় ভাই বোন। বাবার চাকরির সুবাদে তার পুরো পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন।  তিনি উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বর্তমানে তিনি বিএসটিআই এ রসায়নের পরীক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

শৈশব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পড়াশোনার হাতেখড়িটা হয় বড় বোনদের কাছে ছড়া আর বর্ণমালা শিখে। ওরা তখন কেউ  কলেজে, কেউ হাই স্কুলে পড়ত। চরাঞ্চলে অবস্থিত আমার সেই গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছায়নি। হারিকেনের মৃদু আলোতে আমার সব ভাই বোনদের দেখতাম পড়ার ঘরে পাশাপাশি বসে পড়ছে। কেন যেন সে দৃশ্যটা আমার খুবই ভালো লাগত। সে দৃশ্যটি পড়াশোনার প্রতি আমার মনে একটা আগ্রহের জন্ম দেয় শৈশবেই। বিশেষ করে স্কুল জীবনে যতটুকু শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ততটুকু বেশ আনন্দ নিয়েই শিখেছি। 

তার শিক্ষা জীবন কেমন ছিল প্রশ্নে তিনি জানান, নানান ঘটনা আমার জীবনের গন্তব্য বদলে দিয়েছে বারবার। যেমন এইচএসসিতে বাংলা এবং ইংরেজিতে এ প্লাস না থাকায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার জন্য বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও দেয়ার সুযোগ পাইনি। পরে অনেক চিন্তাভাবনা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই। ইচ্ছা ছিল মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতক শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যাব। এরপর যখন ৪র্থ বর্ষে উঠলাম তখন বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ভাই বোন সকলেই নিজ পরিবারের সাথে আলাদাই থাকত বেশ আগে থেকেই।

তিনি জানান, বাবার মৃত্যুর পর মাকে একা রেখে দেশত্যাগের কথা আর ভাবতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম যা করব দেশে থেকেই করব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই টিউশনি, বিভিন্ন কোচিংয়ে ক্লাস নেয়া শুরু করেছিলাম। বন্ধের সময় ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় গিয়েও ক্লাস নিতাম। বাবা অবসরে চলে যাওয়ায় পরিবারের অর্থের চাহিদা মেটাতে তখন এসবের প্রয়োজনও ছিল খুব বেশি। তবে পড়াতে এবং ক্লাস নিতে আমার দারুণ ভাল লাগত। সেই সাথে ছোটখাটো একটা পরিবার চালানোর মত টাকা প্রতি মাসেই আয় করতে পারতাম। অনার্স শেষে শুরু হলো মাস্টার্স এর ক্লাস। এরপর এলো কোভিডের ধাক্কা। তখন অনলাইনে টিউশন পড়াতাম, নিজস্ব একটা অনলাইন ব্যাচও পড়াতাম।

May be an image of 1 person

বিসিএসে তার সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রথম বিসিএস হিসেবে ৪১ তম বিসিএস পাই। তবে নানা কারণে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। প্রিলিতে অকৃতকার্য হই সেবার। এরপর একটা জেদ চেপে বসল। বিসিএস সিলেবাসটা ভালোমতো অ্যানালাইসিস করলাম। মনে হলো আমি চেষ্টা করলে অবশ্যই এর ওপর একটা ভালো দখল চলে আসবে। মাস্টার্স শেষ হলো। চিন্তা করলাম আপাতত কোন ফুলটাইম চাকরিতে না ঢুকে টিউশন এবং ক্লাস নেয়ার মতো কাজে থাকলেই ভালো হবে। এর ফলে নিজের মতো সময় করে বিসিএস এর জন্য পড়াশোনা করতে পেরেছিলাম। পরের বিসিএস ছিল ৪৩ তম।

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, দিনে টিউশন, ক্লাস নেয়া শেষ করে রাতে পড়ার জন্য সময় রাখতাম। কষ্ট হতো, তবে হাল ছাড়িনি। এরই মধ্যে ২০২২ সালে বিএসটিআই এর চাকরিটা হয়। এটাও প্রথম শ্রেণির চাকরি। পড়ার জন্য সেই রাত কেই বেছে নিতে হতো। ৪৩ এর রেজাল্টের আগে অনেক দ্বিধায় ছিলাম যে আদৌ কোন ক্যাডার আসবে কিনা। কারণ মনে হচ্ছিল আমার চেষ্টায় ঘাটতি ছিল। এত বড় একটা পরীক্ষা যেখানে দেশের সব তুখোড় মেধাবীদের সাথে লড়তে হবে সেখানে নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিতে না পারলে দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। আর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু বিসিএস নিয়ে পড়ে থাকবার মতো বিলাসিতা কখনো করতে পারিনি। তবে আলহামদুলিল্লাহ মহান সৃষ্টিকর্তা হতাশ করেননি। পুলিশ ক্যাডার পেয়ে আমি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।

বিসিএস হওয়ার পেছনে কাদের ধন্যবাদ দিতে চান প্রশ্নে তিনি জানান, ৪৩ এর রেজাল্ট হবার পর নিজের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল বাবার কথা। বেঁচে থাকলে আনন্দে কাঁদতেন, তার চেহারা টা বারবার মনে পড়ছিল। কত স্বপ্নই না দেখতেন বাবা আমাকে নিয়ে। আমার মায়ের মুখটাই আমার ভেতরের শক্তি। বৃদ্ধ এবং অসুস্থ শরীর নিয়েও আমি চাওয়ার আগে আমার প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে রাখতেন এবং সময়মতো সামনে এনে দিতেন। আমার সফলতায় মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। ভাইয়া এবং আপুরা জীবিকা এবং পারিবারিক প্রয়োজনে দূরে থাকলেও যেকোনো প্রয়োজনে ডাকলেই কাছে পেতাম ওদের। শত ব্যস্ততা ফেলেও আমার পাশে এসে দাঁড়াত। তাদের ভূমিকাও অনেক ছিল।

সজীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভালো বির্তাকিকও ছিলেন। স্কুল থেকে বিতর্কের সাথে যুক্ত ছিলেন। বিটিভি স্কুল বিতর্কে অংশ নেন তিনি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির হয়ে বিতর্ক করেন অনেক জায়গায়।  ২০১৮ সালে কুয়েটে অনুষ্ঠিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ান পার্লামেন্টারি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

পরিশেষে তিনি তার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে বলেন, পুলিশের দায়িত্ব অনেক বেশি, কাজও বেশ চ্যালেঞ্জিং। সবাই দোয়া করবেন নিষ্ঠার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করার মত শারীরিক ও মানসিক শক্তি ধরে রাখতে পারি শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত।


সর্বশেষ সংবাদ