রাজমিস্ত্রীর কাজ করা রনি এখন কুয়েটের শিক্ষার্থী

কুয়েটের শিক্ষার্থী রনি ইসলাম
কুয়েটের শিক্ষার্থী রনি ইসলাম   © টিডিসি ফটো

দরিদ্র পরিবারে জন্ম মো. রনি ইসলামের। ছোট বেলা থেকেই অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। বাবা আদর সোহাগ পাননি। মা-ছেলে মিলেই তাদের ছোট সংসার। তার মা আর ডি এ এর একটি প্রজেক্টে ৬ হাজার টাকা বেতনে পিয়নের চাকরি করতো। তা দিয়েই সংসার চলতো। পরিবারের হাল ধরতে স্কুল জীবনে করেছেন রাজমিস্ত্রীর কাজ। সেই রনি এখন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র। 

তার সংগ্রামের গল্প বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। রনি বলেন, বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের গাড়িদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনি পরীক্ষায় পাশ করি। তারপর ভর্তি হলাম বগুড়া জেলার সনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে। আমার অবস্থার কথা বিবেচনা করে বেতনসহ অনান্য ফি কমিয়ে দিয়েছিলো স্কুল, কলেজ কর্তপক্ষ। যার কারনে আমার পক্ষে পড়াশোনা চালানো সম্ভব হয়েছে। তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। 

বন্ধুদের অবদানের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, যেহেতু প্রাইভেট পড়ার টাকা ছিলো না তাই পড়া ভালোভাবে বোঝার জন্য বন্ধুদের দ্বারস্থ হতাম। তবে আমি খুব গরিব  বলে তারা কখোনই অবহেলা করে নাই। তারা আমার সাথে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই বজায় রেখেছে। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৮ সালে এস এস সি ও ২০২০ সালে এইচ এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। 

রাজমিস্ত্রীর কাজ করার প্রসঙ্গে রনি বলেন, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা এর পর রাজমিস্ত্রীর কাজ করেছিলাম। সম্ভবত আড়াই মাসে প্রায় ২০ হাজারের বেশি টাকা উপার্জন করেছি। 

আরও পড়ুন: হুইলচেয়ারে বসে মেজর র‍্যাংক ব্যাজ পরলেন জীবন যুদ্ধে হার না মানা কানিজ

যেখানে আমাদের নুন আনতে পানতা ফুরায় সেখানে আমার আমাকে বগুড়ার স্বনামধন্য স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন। আমার শিক্ষকদের মধ্যে আমাকে অনেক গাইড বই দিয়ে বা বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়িয়ে অনেকভাবে সাহায্য করেছেন।

শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নবম ও দশম শ্রেণীতে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক রতন স্যার আমাকে ফ্রিতে ইংরেজি  পড়িয়েছিলেন। এরপর একাদশ শ্রেণীতে ওঠার পরে সেখানকার ইংরেজি শিক্ষক বেলাল হোসেন স্যারও আমাকে ফ্রিতে পড়াতেন এবং অনেক বই দিয়েও সহায়তা করেছিলেন। আর আমার কলেজের গৌতম স্যার, ইকবাল স্যার, জিয়াউল স্যার সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিতেন। তাদের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তাদের ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না। 

এইচএসসি পাশ করার পর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে রাজশাহী চলে যান রনি। সেই দিনগুলোর কথা বর্ণণা করতে গিয়ে রনি বলেন, কি যে কষ্ট করে চলতে হতো! মা যে টাকা পাঠাতো তাতে হতো না। বাধ্য হয়েই মাঝে মাঝে দিন মজুরে কাজ করতাম। কখনো রাজমিস্ত্রী আবার কখনো ইট ভাঙ্গা শ্রমিকের কাজ করেছি। তবে পড়াশোনা থামাইনি কখনও। শত কষ্টের মাঝেও পড়া চালিয়ে গেছি। 

এরপর ভর্তি পরীক্ষার সময় চলে এলো বেশি জায়গায় আবেদন করার মতো টাকা আমার কাছে ছিল না। আমি ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। বুয়েট এ পরীক্ষা দেবার মতো পর্যাপ্ত নম্বর আমার ছিলনা তাই আমার শেষ ভরসা ছিল রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট।

এর মাঝে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ইউনিট এ পরীক্ষা দিয়ে ১৫০৫ তম হই সেখানেও ভর্তির সুযোগ হলেও ভর্তি হইনি। এর পর প্রকৌশলী গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে আমি কুয়েটে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হই। আমার মায়ের একক চেষ্টা ও সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতের ফলে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। 

রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা শেযার করে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে নিজের চোখে যে দূর্নীতিগুলো দেখেছিলাম তা বলার মতো না। দেখেছিলাম বিল্ডিংয়ে রড ছাড়া নিল টন ঢালাই দিতে। ১০ বস্তা বালিতে ১ বস্তা সিমেন্ট দিতো তারা। যেগুলোর প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থাকলেও আমি পারিনি প্রতিবাদ করতে। এগুলো আমাকে আরো অনুপ্রাণিত করতো যে একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশটাকে বদলে দেবো। 

পড়াশোনা চালিয়ে যেতে এখনও আমাকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। জানিনা কত দূর যেতে পারবো। দিনশেষে একটাই চাওয়া আল্লাহ যেন আমাকে সৎ মানুষ এবং সৎ ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার তৌফিক দান করে। 


সর্বশেষ সংবাদ