‘হোটেল বয়’ আসিফ এখন জবি ছাত্র

আসিফ আলী
আসিফ আলী  © সংগৃহীত

আসিফ আলী। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার স্বরূপনগর গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। ছোট থেকেই নানা রকমের অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে গেছে তার জীবন। এত বাধা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ঢাকা, জগন্নাথ, রাজশাহী ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। এই অভাবের কারণে কখনো হয়েছেন দিনমজুর, কখনো দোকানের কর্মচারী আবার কখনো হোটেল বয়। তার জীবনযুদ্ধের গল্প বলেছেন তিনি।

আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার দাদা মারা যান। অভাব কি জিনিস তখন বুঝতে শুরু করলাম। দাদা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই সময় আম্মু একটা ছাগল কিনলেন ধারদেনা করে। এভাবে পরিবার চলছিল না। এই টানাপোড়নের মধ্যে এক বৃষ্টির দিনে পিছলে পড়ে আম্মুর হাতের হাড় ভেঙে গেল। এলাকার সমিতি থেকে অনেক কষ্ট করে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। সেই থেকে বলতে গেলে আম্মুর ডান হাত অচল।

আরও পড়ুন: ৩১ বছর ধরে বন্ধ নির্বাচন, চাকসু এখন ‘বিয়ের ক্লাব’

এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর একটা হোটেলে কাজ নিলাম। খাওয়া ফ্রি। দিনে ৫-১০ টাকা করে দিত। স্কুলের সময় চলে যেতাম। গ্রামের মেম্বার তিন হাজার টাকার বিনিময়ে একটা কার্ড করে দিয়েছিলেন। ৩০০ টাকায় ৩০ কেজি চাল কেনা যেত প্রতি মাসে। কিন্তু সবজির খুব সমস্যা। দিনের পর দিন এক তরকারি খেতে হতো।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় গ্রামের এক চাচার সবজির দোকানে কাজ নিলাম। বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। সকালে যেতাম। আলু, বেগুন, পটোল ইত্যাদি গুদাম থেকে বের করে পচা-গলা ফেলে বাকিগুলো দোকানে সাজাতাম। পানি ছিটাতাম। স্কুলের সময় চলে যেতাম। সপ্তাহে দুই দিন হাটবার—রবি আর বুধ। এই দুই দিন স্কুলে যাওয়া মানা। কারণ, খুব ভিড় হতো। হাটবারে দুই বেলা খাওয়া, ১০০ টাকা আর বাড়ির জন্য সবজি দিত। এদিকে মায়ের সেই ছাগলটার ছানা হয়। দুটো থেকে চারটা, চারটা থেকে আটটা। কাজ করে যা পেতাম সব মাকে দিতাম। এভাবে একসময় ১১ হাজার টাকায় একটা গরু কিনলেন মা।

আরও পড়ুন: ২২ লাখ শিক্ষার্থীর অপেক্ষার অবসান হচ্ছে কাল

মাকে নতুন কাপড়ে কবে দেখেছি, মনে পড়ে না। ঈদে খুব মন খারাপ হতো। সবাই নতুন পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমার পরনে পুরনো জামা। কোরবানির মাংসের জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতাম। বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা। ততক্ষণে অন্যদের হয়তো খাওয়া শেষ।

যেদিন বাসায় মাছ রান্না করত, সেদিন খুব আনন্দ হত। এলাকায় মাছওয়ালা সিলভার কার্প, কাতল, তেলাপিয়া—এগুলো কেটে কেটে ৩৫ টাকা পোয়া বিক্রি করত। সকাল থেকে অপেক্ষা করতাম কখন মাছ আসবে। মা ভাজবে। আমরা খাব।

একবার টানা তিন দিনের বৃষ্টির পানির তোড়ে আমাদের মাটির ঘরটা ভেঙে পড়ল! পরে এক চাচার বাসায় উঠলাম। এসবের মাঝেই এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। জিপিএ ৪.৮৯। রাজশাহী বোর্ডে ২৫১তম হয়ে মেধাবৃত্তি পেলাম।

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে নজরদারির প্রয়োজন আছে: শিক্ষামন্ত্রী

এরপর রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম। ভর্তি ফি তিন হাজার ৪০০ টাকা। যে দোকানে কাজ করতাম সেই চাচা এক হাজার ৭০০ টাকা দিলেন। হাই স্কুলের এক ম্যাম দিলেন এক হাজার। মেজ মামা ইউনিফর্ম বানিয়ে দিলেন। এলাকার এক বড় ভাই জুতা কিনে দিলেন। একটা বেল্ট কিনেছিলাম ২০০ টাকা দিয়ে। সেটা এখনো পরি। শুক্র-শনি দুই দিন ছুটি থাকত। এই দুই দিন মানুষের জমিতে আলু, পেঁয়াজ, রসুন এসব লাগাতাম।

এইচএসসির পরীক্ষার পর এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেলাম, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন একটা পরীক্ষা নেবে। চান্স পেলে ঢাকায় চার মাস থাকা-খাওয়াসহ ভর্তি কোচিং ফ্রি। যা হোক, কিছুদিন পর মোহাম্মদপুরে গেলাম পরীক্ষা দিতে। প্রশ্ন এত কঠিন হয়েছিল যে পরীক্ষার হলেই কান্না এলো। শেষ পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষায় টিকে ভাইভা দিলাম। ফেরার পথে এসএমএস পেলাম, ‘ইউ আর ফাইনালি সিলেকটেড।’

কোচিং করতে ঢাকায় আসলাম। চার মাস কোচিং করলাম মোহাম্মদপুরে। কোভিড-১৯ এর কারণে বারবার ভর্তি পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছিল। চার মাস পর বাসায় চলে যেতে হবে। তখন মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র নাথ দাদাকে এসএমএস করলাম—দাদা, আমাকে আর দুই মাস থাকার ব্যবস্থা করে দেন। নইলে যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম তা পূরণ হবে না। পরে দাদা আরও তিন মাস থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আরও পড়ুন: এক নজরে দেখে নিন নাসার বর্ষসেরা সব ছবি

সাত মাস পর বাড়ি ফিরে আবার জমিতে রসুন-মরিচ লাগাতে যেতাম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে পেতাম ২৫০ টাকা। কিন্তু এতে পড়াশোনা থেকে আবার দূরে সরে যাচ্ছিলাম। তখন বর্ণ কোচিংয়ের পরিচালক সাইফুর রহমান ও শাকিল আনোয়ার ভাইকে বললাম, আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। শুধু থাকা-খাওয়ার সুযোগ দিলেই হবে। দিনে কাজ করব, রাতে পড়ব। তিন দিন পর তারা ঢাকায় যেতে বললেন। তখন কঠোর লকডাউন। ট্রাকে করে ঢাকায় এলাম। আমার কাজ ছিল ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্ন বানানো। দৈনিক ১০০ টাকা পেতাম খাওয়া খরচ। কোচিং সেন্টারে ঘুমাতাম।

এখন আমার খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। শুধু পরিবার নিয়ে দুমুঠো খেয়ে-পরে চলতে পারলেই হলো।


সর্বশেষ সংবাদ