জ্ঞানের আলো জ্বালানো প্রতিবন্ধী শিক্ষকের এখন চুলা জ্বলছে না
- এম এ আলিম খান
- প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১২:১২ PM , আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১২:২৬ PM
আয়তনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে এই এলাকার মানুষের সাথে এক ধরনের হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে। একইসঙ্গে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সান্নিধ্যও লাভ করেছি।
শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর, তাঁরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু তাঁদের পারিবারিক বা আর্থিক অবস্থার খবর সচরাচর আমরা জানতে চায় না। অনেক শিক্ষক আমাকে বলেন, ‘ভাই পেটে খেলে পিঠে সয়। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে ফ্রী শ্রম দিয়ে যাচ্ছি।’ অনেকের চাকরির বয়স প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু এখনও কোন বেতন পায় না। কারিগর যদি আর্থিক সমস্যায় থাকে তাহলে ভালো মানের পণ্য তৈরি করবে কীভাবে! আর্থিক সমস্যা থেকেই সৃষ্টি হয় পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি। একজন মানুষ এত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও স্কুলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে।
যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের তপোবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের একমাত্র ইংরেজি শিক্ষক শারীরিক প্রতিবন্ধী সুকুমার মন্ডল। যিনি বিনা বেতনে স্কুলে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ছাত্রীদের লেখা পড়া শিখিয়ে আসছেন। আরও মজার ব্যাপার একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে অবস্থিত ওই বিদ্যালয় থেকে প্রায় এক যুগ ধরে কোন শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ফেল করেনি। অন্য বিষয়ে ফেল করে কিন্তু ইংরেজিতে ফেল করে না। ওই শিক্ষক প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন প্রশিক্ষণেও অংশ নিতে পারেন না। প্রশিক্ষণবিহীন ননএমপিও একজন শিক্ষক নিরলসভাবে জ্ঞানের আলো জ্বেলে যাচ্ছেন। স্কুলে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে তারা যা দিতেন তাই দিয়েই ৪ সদস্যের সংসার কোন রকমে চালাতেন। শিক্ষক সুকুমার মন্ডল জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে। সরকার থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। টিউশন বন্ধ থাকায় তাঁর কোন আয় নেই; তাই সংসারও চলছে না। জ্বলছে না ঠিকমত চুলা।
নিরুপায় হয়ে বৃহস্পতিবার আমাকে ফোন করেছিলেন। কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। জানতে চাইলাম সরকারি বা বেসরকারি কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কি না। বুকভরা কষ্ট নিয়ে উত্তর দিলেন না। খোঁজ নিলাম শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমানের কাছে।
তিনি বললেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দুস্থ অসহায় মানুষদের তালিকা তৈরি করে দেন। সেই তালিকা অনুযায়ী সরকারি সাহায্য বিতরণ করা হয়।’ বেসরকারি পর্যায়ে যে সহায়তা করা হয় তা অনেকটা শহর কেন্দ্রিক। গ্রামের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্য এমন সুপ্রসন্ন হয়নি সুকুমার মন্ডলের।
স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ছোট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকেন সুকুমার মন্ডল। জায়গা জমি বলতে তেমন কিছু নেই। তাঁর একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়েটির নাম মোহনা, তার হাতের লেখা অনেক সুন্দর। সে তপোবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী। ছেলেটি স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
সুকুমার মন্ডলের মত অসংখ্য শিক্ষক আছেন যারা নিরবে কাঁদছেন। তাঁরা না পারছেন কারও কাছে কিছু চাইতে; না পারছেন কিছু বলতে। আমাদের চারপাশে এমন যদি কোন শিক্ষক থাকেন তাঁদের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করি আমাদের করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি দিন। সবকিছু স্বাভাবিক হলে ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য। ফুটবে সবার মুখে হাসি।