স্কুলেই ফেসবুক ব্যবহার করে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী

গ্রাফিক্স ছবি
গ্রাফিক্স ছবি

রাজবাড়ীর একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে রফিক। দশম শ্রেণীর গণ্ডি না পেরোলেও কয়েক বছর আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলে সে। দিন যাওয়ার সাথে সাথে ফেসবুকে আসক্তিও বাড়ছিলো তার। এমনকি স্কুলেও ফেসবুকে নজর রাখা শুরু করে। একপর্যায়ে পড়াশোনাতে অমনোযোগী হয়ে পড়ে সে।

এভাবে নেট দুনিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে রফিকের পরিবার। তার বড় ভাই মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এভাবে ফেসবুকে আসক্তির কারণে তার পড়াশোনার মান ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। ফলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পরিবারের সবাই। একপর্যায়ে আমরা তাকে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করতে বলি। এতে সে ফেসবুক ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে দিলেও এর আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে আমরা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

শুধু রফিকই নয়, দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অসংখ্য শিক্ষার্থী এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতেই এ ধরণের প্রবণতা বেশি। তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়াসহ বিভিন্ন অপকর্মেও জড়িয়ে পড়ছে। ফলে অভিভাবকদের পাশাপাশি এতে উদ্বেগ বাড়ছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও।

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতটা আসক্ত হয়ে পড়ছে তা নিয়ে গত বছর একটি জরিপ চালায় জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)। রাজধানী ঢাকার ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪০০ শিক্ষার্থীর ওপর চালানো  জরিপটিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলাফলে কী প্রভাব ফেলছে তাও জানার চেষ্টা করা হয়।

‘সোস্যাল মিডিয়া পার্টিসিপেশন অব দ্য সেকেন্ডারি স্কুলস ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক ওই জরিপে বেশ উদ্বেগজনক তথ্যই উঠে এসেছে। জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্কুল চলাকালেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত থাকে ২৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১৩ শতাংশই পাঠদান চলাকালেই এটি ব্যবহার করছে । বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ে ফোন নিষিদ্ধ করা হলেও শিক্ষার্থীরা লুকিয়ে তা ব্যবহার করছে।

ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. লিয়াকত আলী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী স্মার্টফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকলেও কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে ফোন নিয়ে আসছে। মাঝেমধ্যে শিক্ষকরা কিছু শিক্ষার্থীকে মোবাইলসহ চিহ্নিত করেন। কিন্তু প্রতিদিন তো মনিটরিং করা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, শুধু স্কুলে নয়; বাড়িতেও তারা বড় একটা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে। অনেক অভিভাবকের অভিযোগ, তার সন্তান দরজা বন্ধ করে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সময় কাটাচ্ছে। এতে তাদের পড়ালেখায় মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। নিষেধ করা হলেও অনেক সময় লুকিয়ে তারা এগুলো ব্যবহার করে বলেও জানান অনেকে।

নায়েমের জরিপে অংশ নেয়া ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ভাষ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার তাদের পড়ালেখায় নেতিবাচক প্রভাবে ফেলছে। যে সময়টুকু তারা ফেসবুক কিংবা অন্য সাইটে ব্যয় করছে, আগে এ সময়ের বড় অংশই তারা পড়ালেখায় ব্যয় করত। এর ব্যবহার তাদের বাড়ির কাজেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ কারণে সময়মতো অ্যাসাইনমেন্টও জমা দিতে পারছে না তারা।

ফেসবুকে দৈনিক বড় একটা সময় ব্যয় করেন একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী মাসুম। সামনে পরীক্ষা থাকলেও কিছুতেই এর থেকে বের হতে পারছে না সে। ফলে তার পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তার পরিবারের সদস্যরাও।

মাসুমের ভাই তৌহিদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুক ও ইউটিওবে আসক্ত মাসুম। অনেক বলার পরও সে এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। একপর্যায়ে মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। এতে সে বেশি হতাশ হয়ে যেতে পারে সে আশঙ্কায় তা আর করা হয়নি। ইদানিং ক্লাসেও ফাঁকি দেয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। এর থেকে তাকে বের করে নিয়ে আসতে কোন পন্থাই কাজে আসছে না।’

নায়েমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দৈনিক তিন ঘণ্টার অধিক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করে। এছাড়া দৈনিক ১-২ ঘণ্টা ব্যবহার করে ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর অন্তত ১ ঘণ্টা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটায় মাধ্যমিক পর্যায়ের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও দায় আছে বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, শ্রেণীকক্ষের পাঠদান, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গ্রুপ স্টাডির মধ্য দিয়েই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সময় কাটত আগে। সময়ের পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের সময় কাটানোর ধরন বদলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

এক্ষেত্রে অভিভাবকরা দায় এড়াতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যে ডিভাইসটির মাধ্যমে এ জগতে জড়িয়ে পড়ছে, সেটি সরবরাহ করা হচ্ছে পরিবার থেকেই। ছেলেমেয়ের আবদার মেটাতে গিয়ে তাদের মোবাইল ফোন কিনে দিচ্ছে বাবা মা। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে, সচেতন করে তুলতে হবে। যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় হবে তখ তারা তা করতে পারে বলেও জানাতে হবে তাদেরকে।

নায়েমের জরিপ অনুযায়ী, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহার করছে।অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর মামা আশিকুর রহমান বলেন, কয়েকদিন আগে তার ভাগ্নির কাছে একটি ফোন পান তারা। তার এক বান্ধবীর ফোন ছিলো সেটি। অভিভাবকের নজরে পড়ে যাওয়ায় ফোনটি তার ভাগ্নির কাছে দেয় তার বান্ধবী। এটি নিয়ে বান্ধবী ফেসবুক ব্যবহারসহ অনেকের সাথেই যোগাযোগ রাখতো বলেও জানায় সে।

অনেক সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ঝুঁকিও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিক সময় ব্যয়ের ফলে পড়ালেখার বাইরেও নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কীভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় শিক্ষার্থীরা সেটি স্কুল থেকেই শেখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিক সময় ব্যয়ের কারণে তারা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সামাজিকীকরণ ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, এটি একজন শিক্ষার্থীর জন্য ঝুঁকিও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা যেসব সম্পর্কে জড়ায়, এর বেশির ভাগই ভূয়া। অনেক সময় ধরে মোবাইল ব্যবহারের কারণে তাদের ফিজিক্যাল মুভমেন্টও কম হয়। অনেকক্ষণ ধরে স্থির হয়ে বসে কিংবা শুয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ঘাড় বাঁকা করে রাখে। এতে তারা শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিষয়ে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে নায়েমের ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারগুলোয় জনপ্রিয় বই, জার্নাল ও ভ্রমণকাহিনী সংগ্রহ রাখা, যাতে শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারমুখী হয়; সরকারকে সোস্যাল মিডিয়ায় অংশগ্রহণের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা।

শিশু-কিশোরদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কুফল নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। গত বছর একদল মার্কিন শিশুকল্যাণ বিশেষজ্ঞ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের কাছে একটি চিঠিতে ‘মেসেঞ্জার কিডস’ নামে শিশুদের মেসেজিং অ্যাপ বন্ধ করে দেয়ার আহবান জানান। ফ্রান্স সরকার সে দেশের বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধে আইন পাস করেছে। ফ্রান্সের এ আইন অনুযায়ী, ১৫ বছরের নিচে কোনো শিশু বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট কিংবা ইন্টারনেট সংযুক্ত ডিভাইস আনতে পারবে না।

২০১৭ সালে শ্রেণীকক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশও। তবে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিদ্যালয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘এ আদেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষকদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে শিক্ষার্থীদের ভালো লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা।’

তিনি বলেন, এটি ব্যবহারের ফলে তাদের সময় অপচয়সহ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের তা ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝাতে হবে। জোরজবরদস্তি করে এটি বন্ধ করা যাবে না। এছাড়া শিক্ষকদের উচিত অংশগ্রহণমূলক পাঠদানের মাধ্যমে শ্রেণীকক্ষকে আনন্দদায়ক করে গড়ে তোলা, যাতে শিক্ষার্থীরা অন্যদিকে মনোযোগের সুযোগ না পায়। পাশাপাশি কম বয়সী ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবাদেরও আরো বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ