দু’পায়ে ৭০ ছররা গুলি, পাশের গলিতে গিয়ে রক্ষা পান রুকন

রুকন শাহ
রুকন শাহ  © টিডিসি ফটো

জুলাই গণঅভুত্থানে সারা দেশে সংঘাত–সহিংসতায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে সরকার গঠিত কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ছাত্র-জনতা এ আন্দোলনে আহতদের অনেকে অসহ্য যন্ত্রণা আর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দিনযাপন করছেন। কেউ হাত হারিয়েছে, আবার কেউ হারিয়েছেন পা। কারো চোখের আলো নিভে গেছে। এমনই একজন সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রুকন শাহ।

আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় পুলিশের গুলিতে হয়েছেন আহত। করাতে পারেননি ঠিকভাবে চিকিৎসা। এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তার ক্ষত চিহ্ন। কেমন যাচ্ছে এ শিক্ষার্থীর জীবন?

হাঁটতে পারছিলাম না, পড়ে যাচ্ছিলাম। তখন মনে মনে ভাবছিলাম, এখন যদি আমি পড়ে যাই তাহলে নিজেকে আর বাঁচাতে পারব না। ওরা এসে আমাকে গুলি করে শেষ করে ফেলবে। মনকে শক্ত করে পিছু হাঁটতে শুরু করলাম।

রুকন শাহ বলেন, কোটা আন্দোলনের সময় যার যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ১৭ জুলাই কাজলায় ছাত্রদের মিছিলে টিয়ারশেল ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করবার চেষ্টা করেছে পুলিশ। যখন টিয়ারশেল ছুঁড়েও ব্যর্থ পুলিশ বাহিনী, তখন ছুঁড়েছে রাবার বুলেট। প্রথমদিনেই আন্দোলনে কয়েক দফা রাবার বুলেটের আঘাতে আহত আমি। কিন্তু ভেঙে পড়িনি, ভয় পাইনি, পিছিয়ে যায়নি। অদম্য সাহস সঞ্চয় করে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে পরেরদিন আন্দোলনে যোগ দিই।

দিনপঞ্জিতে তারিখটা ১৮ জুলাই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ ও ছাত্রজনতা মুখোমুখি। শনির আখড়ার দিকে ছাত্রজনতার অবস্থান আর যাত্রাবাড়ীর দিকে পুলিশের। তারা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে একের পর এক টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু এতে কোনো কাজই আসে না। বেগতিক দেখে পুলিশ হঠাৎ করে ছররা গুলি নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ীর প্রশস্ত মেইন রাস্তায় আমার সামনে প্রায় হাজার পাঁচেক ছাত্রজনতা। হঠাৎ করে কয়েকটা গুলি এসে লাগে তাঁর দু’পায়ে। তখনও মনোবল দৃঢ় রেখে ভেবেছিলাম হয়ত দু একটা গুলি এসে পায়ে লেগেছে।

রুকন শাহ’র ভাষ্য, হাঁটতে পারছিলাম না, পড়ে যাচ্ছিলাম। তখন মনে মনে ভাবছিলাম, এখন যদি আমি পড়ে যাই তাহলে নিজেকে আর বাঁচাতে পারব না। ওরা এসে আমাকে গুলি করে শেষ করে ফেলবে। মনকে শক্ত করে পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। খানিক যাওয়ার পর ওই দিকের কোন এক গলির ভেতর ঢুকে পড়ে যাই। পরে অবচেতন হয়ে পড়ি।

তিনি আরো বলেন, যখন জ্ঞান ফেরে, তখন আমি শনির আখড়ার কোনো এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জানতে পারি, স্থানীয় কিছু লোকজন আমাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছেন। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক্স-রে করে জানালেন, আমার দু’পায়ে ৭০টির অধিক গুলি লেগেছে। যেগুলো সম্ভব বের করেছেন বাকিগুলো এখনো ভেতরেই আছে।

কুতুবখালীর দিকে মেসে থাকতেন রুকন। তিনি বলেন, কাজেই সেখানে যেতেও ভরসা পেলাম না। হাসপাতালে কর্তৃপক্ষকে বললাম, আমাকে ভর্তি নিতে। তারা বললেন, আপনাদের চিকিৎসা দেয়াই তো অবৈধ। শুধু মানবিকতার খাতিরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া। এই কথা বলে আমাকে বাসায় যেয়ে বিশ্রাম নিতে বলে দিল।

ডাক্তার বললেন, আমাকে তার চেম্বারে যেতে হবে সকালের দিকে, কেউ আসবার পূর্বেই তাকেই দেখে চিকিৎসা দিয়ে দেওয়া হবে। তার কথামতো কাজ হল। সকালে কেউ আসবার পূর্বেই তাকে দেখিয়ে এলাম।

মেসে এসে শুরু হল আরেক আতঙ্ক। পুলিশ আসবে না, আমায় ধরে নিয়ে যাবে না তো। কারণ এর আগে শুনলাম পুলিশ নাকি খুঁজে খুঁজে মেস বের করে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যে মেসে থাকতাম তার বাড়িওয়ালা ছিল খুব ভাল। তিনি বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। ডিজিটাল ক্র‍্যাকডাউন থাকায় ইন্টারনেটে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। মেসেরই পরিচিত ভাইদের সহায়তায় কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিলে সেগুলো এনে খাই।

পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হলে ২৮ তারিখে গ্রামেরবাড়ী টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। বাড়িতে গিয়ে প্রথমবারের মতো বাবা মাকে আমার গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানাই এবং তাদের বলি এসব কথা গোপন রাখবার জন্য।

গ্রামে এসে আবারও ডাক্তারের সন্ধান করতে থাকি। কিন্তু কেউ চিকিৎসা সেবা দিতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে একজন স্থানীয় এমবিবিএস একজন চিকিৎসক রাজি হল। তার নাম ডা: হাসান হাফিজুল রহমান, তিনি কিডনি বিশেষজ্ঞ। বাধ্য হয়ে সেখানেই রাজি হয়ে যাই। তবে তিনি একটি শর্ত জুড়ে দিলেন। ডাক্তার বললেন, আমাকে তার চেম্বারে যেতে হবে সকালের দিকে, কেউ আসবার পূর্বেই তাকেই দেখে চিকিৎসা দিয়ে দেওয়া হবে। তার কথামতো কাজ হল। সকালে কেউ আসবার পূর্বেই তাকে দেখিয়ে এলাম। তিনি একটি এক্সরে করতে বললেন। এক্সরে করালাম, রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানালেন, এখনো আমার শরীর ৪০ টির অধিক গুলি লেগে আছে। এবং যদি আমি অপারেশনের মাধ্যমে সেগুলোকে অপসারণ করতে যাই তবে সেটা হবে আমার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। 

৫ ই আগস্টের পর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দেশ ফিরতে শুরু করলে। আমিও গ্রাম থেকে ঢাকা আসি। এবার আমি নিজ উদ্যোগে যোগাযোগ করি ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে আরও একটি এক্সরে করাতে বলে। সে রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে তারাও আমাকে একই কথা বলে। অপারেশন করলে ক্ষতির বাড়তে পারে এর বেশি সে কিছু জানি না। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন বয়ে নিতে যেতে হবে জুলাই আন্দোলনের এই স্মৃতি। 

বর্তমানে আমার কোনো সমস্যা নেই। নিয়মিত ক্লাসে আসছি। ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছি। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছি। স্বাধীন দেশে মুক্তভাবে নিশ্বাস নিচ্ছি। কিন্তু এখনো হাঁটুতে হাত দিলে অনুভূত হয় বুলেটের সেই ক্ষত চিহ্ন।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence