প্রভাষকের দ্বিগুণ অধ্যাপক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে

  © প্রতীকী ছবি

দেশের কোনো স্বায়ত্তশাসিত বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেলেই হলো, অধ্যাপক হওয়া তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশেষ কোনো যোগ্যতা ছাড়াই কয়েকবছর পর নামের পাশে যুক্ত হবে অধ্যাপক পদবি। বাড়বে বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি।

এই প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক হওয়ার চেয়ে প্রভাষক হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। নতুন পদ না থাকায় প্রভাষক পদে নিয়োগের গতি মন্থর থাকলেও আপগ্রেডেশন-প্রমোশনের বদৌলতে অধ্যাপক নিয়োগের গতি লাগাম ছাড়া। অর্থ্যাৎ, একবার প্রভাষক পদে নিয়োগ পেলেই মিলছে সহাকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সবশেষে অধ্যাপক হওয়ার নিশ্চয়তা। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রমোশনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের যোগ্যতা মাপা হয় গবেষণা, অর্জন ও জার্নাল দিয়ে। আর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে শিক্ষকের চাকরির বয়স। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন প্রভাষক সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। 

বর্তমানে দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষক রয়েছেন ১৫ হাজার ৪২৬ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক চার হাজার ৫২৮ জন, সহযোগী অধ্যাপক দুই হাজার ৬৫৭ জন, সহকারী অধ্যাপক পাঁচ হাজার ২৮৩ জন, প্রভাষক দুই হাজার ৬৭২ জন এবং অন্যান্য শিক্ষক রয়েছেন ২৮৬ জন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) এর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি অধ্যাপক রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রয়েছেন ৮৭১ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৪২৬ জন, সহকারী অধ্যাপক ৬১০ জন এবং প্রভাষক রয়েছেন মাত্র ৩২৭ জন। 

একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে  প্রভাষকের তুলনায় অত্যাধিক সংখ্যক অধ্যাপক রয়েছেন।

এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট এক হাজার ৯৭ জন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক ৫৬৮ জন এবং প্রভাষক রয়েছেন মাত্র ৫৬ জন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) মোট ৫৯১ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩১৯ জন অধ্যাপক ও প্রভাষক রয়েছেন ২৪ জন। বুয়েটে ২০৩ জন অধ্যাপকের বিপরীতে প্রভাষক রয়েছেন ১২৬ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন ৪১০ অধ্যাপক ও ১৬৫ প্রভাষক। এছাড়া, উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭৯ জন অধ্যাপকের বিরীতে রয়েছেন মাত্র ৯ জন প্রভাষক।

অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে চাকরির বয়সকে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা এবং এই প্রক্রিয়ায় অধ্যাপকের সংখ্যা বৃদ্ধি  উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন ও মানোন্নয়নে কেমন ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। বিভিন্ন সময় পদোন্নতির এই পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এতে কেবল সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষায় এমন নীতির কুফল মিলছে হাতে নাতে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে জায়গা পাচ্ছে না। অথচ আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, আমাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়া হয় তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না। শিক্ষকদের মধ্যে যিনি গবেষণা করেন, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করেন তিনিও অধ্যাপক হন, আর যিনি কেবল ডিপার্টমেন্টে নির্দিষ্ট কয়েকবছর যাতায়াত করেন তিনিও অধ্যাপক হন। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এই অপরিণামদর্শী পদ্ধতিগুলো পরিহার করা উচিৎ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হওয়াটাকে দেখা হয় বেতন বৃদ্ধি হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য রিস্ট্র্যাকচারিং নামে একটি ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ পদ না থাকলেও যদি যোগ্যতা থাকে তাহলে লেকচারার পদটিকে অধ্যাপক পদ বানিয়ে ফেলতে পারে।

“এর ফলে ঢাবিতে অধ্যাপকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে এ যোগ্যতার মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একই অবস্থা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। এর ফলে আমাদের দেশে অধ্যাপক পদে প্রমোশন পেয়ে শিক্ষকরা সেটিকে উদযাপন করেন না। কেননা আমাদের দেশে যে কেউ অধ্যাপক হয়ে যান।”


সর্বশেষ সংবাদ