নর্থ সাউথে স্বেচ্ছাচারী-দুর্নীতিপরায়ণ ট্রাস্টিদের পুনর্বাসন হচ্ছে?

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়  © সম্পাদিত

দেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষায় রোল মডেল নর্থ সাউথ ইউনিভিার্সিটি (এনএসইউ)। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন র‍্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে দেশ সেরার খেতাবও পেয়েছে এ উচ্চশিক্ষালয়। মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার জন্য সুনাম কুড়ালেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়েছে এনএসইউ। শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী নয়; বরং এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগই এনএসইউ ট্রাস্টিদের ঘিরে।

বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের অর্থে রেঞ্জরোভার কিনে গাড়িবিলাস, নিয়মবহির্ভূত মোটা অঙ্কের সিটিং অ্যালাওন্স গ্রহণ, জমি কেনার নামে অর্থ আত্মসাৎ— এমন অসংখ্য অভিযোগ ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রমাণিত হওয়ায় ২০২২ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আজিম উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ট্রাস্ট ভেঙ্গে নতুন বোর্ড গঠন করে দেয় রাষ্ট্রপতি। ওই সময় আজিম উদ্দিনসহ ৬ জন সদস্য বাড় পড়েন। যদিও সম্প্রতি পুনর্গঠিত ওই বোর্ডের কার্যকারিতা স্থগিত করার পর পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিয়েছে আজিম উদ্দিনের ওই বোর্ড। দখলে নেয়ার পর গত এক সপ্তাহ ফের বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে নর্থ সাউথ প্রাঙ্গণ। বোর্ড কর্তৃক রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারাধীন ক্ষমতা চর্চাসহ নানা স্বেচ্ছাচারী কার্যক্রমে জড়িয়েছে আজিম উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বোর্ড। এতে করে উচ্চশিক্ষা খাতে প্রশ্ন উঠেছে,  নর্থ সাউথে স্বেচ্ছাচারী-দুর্নীতিপরায়ণ ট্রাস্টিদের পুনর্বাসন হচ্ছে কী?

‘আমি এখন আর নর্থ সাউথের খোঁজখবর রাখি না। আদালতের রায়ের মাধ্যমে যারা এখন পুনরায় ফিরে আসছেন তারাও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাকে কিন্তু সরকার সরায়নি, তারা সরিয়েছিল এম এ আউয়াল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন আজীবন সদস্য এবং নর্থ সাউথ ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

জানা যায়, শিক্ষাবিদ, আমলা, রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত ৩০ সদস্য নিয়ে গড়ে ওঠা ফাউন্ডেশন ফর প্রমোশন অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (এফপিইআর) আওতায় ১৯৯২ সালে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে সেটির নাম পরিবর্তন করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ফাউন্ডেশন (এনএসইউএফ) করা হয়। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর পর সেটিকে রূপ দেয়া হয় দ্য নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টে। ট্রাস্ট রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রতিষ্ঠাকালে অবদান রাখা ফাউন্ডেশনের অনেক শিক্ষানুরাগী সদস্যকে বাদ দিয়ে শুধু অর্থ দিয়ে সহায়তা করা ব্যক্তিদের (একেকজন ট্রাস্টি সর্বোচ্চ ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন) ট্রাস্টি করা হয়। ফলে ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ট্রাস্টি সদস্যদের প্রভাব বাড়তে থাকে নর্থ সাউথে।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় সুশাসনের দায়িত্বে থেকে নিজেই নানা অপকর্মে জড়ান ড. সাজ্জাদ

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় যে ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তার ডিডে বলা হয়েছে, এ ট্রাস্ট মানবহিতৈষী, দানশীল, জনহিতকর, অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও অবাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হবে। যদিও ব্যবসায়ী ট্রাস্টিরা নেতৃত্বে আসার পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক ও লাভজনক হয়ে উঠে এনএসইউ ট্রাস্ট। নতুন নতুন নিয়ম তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে নানা আর্থিক সুবিধা ভোগ করা শুরু করে ব্যবসায়ী ট্রাস্টিরা। এমনকি নিয়মবহির্ভূতভাবেও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়ান কয়েকজন ট্রাস্টি।  শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বেশ কয়েকটি তদন্তে নানা ট্রাস্টিদের নানা অনিয়মের প্রমাণ মেলে।

ছবি: নর্থ সাউথ ইউনিভিার্সিটি (এনএসইউ)

২০১২ থেকে ২০২২- এ এক দশকে সবচেয়ে বেশি লুটপাট করে এনএসইউ ট্রাস্টিরা। এ এক দশকে বিভিন্ন ভাতা বাবদই ১৭ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে তুলে নিয়েছেন কয়েকজন ট্রাস্টি। প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা নয়টি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেছেন নয়জন ট্রাস্টি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তদন্তে ট্রাস্টিদের এসব অনিয়ম প্রমাণিত হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কেনাকে কেন্দ্র করে পাঁচজন ট্রাস্টি ৮১ কোটি ২৫ লাখ টাকা একটি হাউজিং কোম্পানি থেকে ঘুস নিয়েছেন বলে  দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক তদন্তে উঠে আসে। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠাকালে সাত লাখ টাকা করে সহায়তা দেয়া ট্রাস্টিরা এর কয়েকগুণ করে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে নানা উপায়ে তুলে নিয়েছেন।

নতুন করে দখলে নেয়া পুরোনো সেই বিওটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই বেশকিছু স্বেচ্ছাচরিতার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে গিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে উপাচার্য আতিকুল ইসলামকে ছয় তলা থেকে ফেলে দেয়াসহ নানা হুমকি প্রদান করেন পুরোনো ট্রাস্টসংশ্লিষ্ট কয়েকজন। এমনকি বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে চাকরি থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দিয়ে মোবাইলে মেসেজ পাঠান পুরোনো বিওটি সদস্য মোহাম্মদ শাহজাহান।

বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কথা উল্লেখ করে ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারা ৩৫(৭) প্রয়োগ করে এনএসইউ’র বিওটি পুনর্গঠন করে রাষ্ট্রপতি। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্ষদ থেকে ৬ জন সদস্য বাদ পড়েন ও ৪ জন নতুন করে যুক্ত হন। এর মধ্যে পাঁচজন প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা। তারা হলেন, আজিম উদ্দিন আহমেদ, রেহানা রহমান, এমএ কাশেম, মোহাম্মদ শাজাহান ও বেনজীর আহমেদ। বাদ পড়া বাকি সদস্য ছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন আরেক উদ্যোক্তা এমএ হাসেমের ছেলে আজিজ আল কায়সার।

আরও পড়ুন: ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ

পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বিওটিতে যুক্ত হওয়া চারজন হলেন অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম, জাভেদ মুনির আহমেদ, ফাইজা জামিল ও শীমা আহমেদ। এর মধ্যে তখন ড. আতিকুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাকে শিক্ষাবিদ হিসেবে যুক্ত করা হয়। এছাড়া বাকি তিনজন ছিলেন উদ্যোক্তা ট্রাস্টির অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিনের পরিবারের সদস্য।

ওই সময় এনএসইউ ট্রাস্ট পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। একটি পক্ষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ায় ওই সংস্কারকে সাধুবাদ জানায়। অন্যদিকে কেউ কেউ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় দ্বিচারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। বিশেষ করে বাদ পড়া ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, একই ধরনের অনিয়ম করা সত্ত্বেও ইয়াসমিন কামাল, ফৌজিয়া নাজ ও তানভীর হারুনকে ট্রাস্টে রাখা নিয়ে বেশ সমালোচনা ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়। অন্যদিকে কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও উদ্যোক্তা এমএ হাসেমের ছেলে আজিজ আল কায়সারকে বিওটি থেকে বাদ দেয়া হয়। এছাড়া উপাচার্যের পদে থাকা অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম হঠাৎ করে শিক্ষাবিদ ক্যাটাগরিতে ট্রাস্টি বনে যাওয়া নিয়েও বেশ বিতর্ক তৈরি হয়। এমনকি একইসঙ্গে উপাচার্য ও বিওটি সদস্য পদে থাকার সুযোগ রয়েছে কিনা, সেটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসুস্থতাজনিত ছুটিতে রয়েছি। হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়ে এখন আমি বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছি। ইতোমধ্যে পুরোনো ট্রাস্টিদের অনেকের পক্ষ থেকে হুমকি পাচ্ছি। আমার নিয়োগ বাতিল বিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে পাইনি প্রফেসর আতিকুল ইসলাম, উপাচার্য ,নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

তবে পুনর্গঠন হওয়া বোর্ড দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে পুনর্গঠিত বোর্ডের প্রথম সভায়ই ট্রাস্টি বোর্ড সভার সম্মানী ৫০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া অন্যান্য কমিটিতে যে ২৫ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হতো তা কমিয়ে ৬ হাজার করা হয়েছে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য জুনায়েদ কামাল আহমেদও কোনো সভায় সম্মানী নেবেন না বলে ওই সভায় জানায়। পাশাপাশি অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম উপাচার্যের দায়িত্বে থাকায় তিনিও কোনো ধরনের সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করতেন না। এছাড়া পূর্বেকার ট্রাস্টিরা প্রত্যেকে বছরে দুইজন করে শিক্ষার্থী বিনা অর্থে ভর্তি করাতে পারলেও সে সুবিধাও না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাস্টিরা।

আরও পড়ুন: নর্থ সাউথের ট্রাস্টি বোর্ড অবৈধ: হাইকোর্ট

এ প্রসঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের উদ্যোগে নর্থ সাউথের বোর্ডে সংস্কার করা হয়। নতুন বোর্ডে শিক্ষাবিদ হিসেবে আমাকে যুক্ত করায় অন্য অনেকের মতো আমিও অবাক হই। কেননা আমি উপাচার্য হিসেবে পদাধিকারবলেই বোর্ডের সদস্য। আমার সঙ্গে কোনো আলাপ ছাড়াই আমাকে পুনর্গঠিত বোর্ডের সদস্য করা হয়। এতে করে বাদ পড়া সদস্যরা আমাকে স্বাভাবিকভাবেই শত্রু মনে করেন। তারা মনে করতে শুরু করে, তাদের বাদ পড়ার ক্ষেত্রে আমি ভূমিকা রেখেছি। অথচ আমি উপাচার্য পদের দায়িত্বের বাইরে কোনো প্রক্রিয়ায় যুক্তই ছিলাম না। যেহেতু মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে এ বোর্ড গঠন হয়, এজন্য আমি এর প্রতিবাদও করিনি। তবে ট্রাস্টি হিসেবে আমি কোনো ধরনের আর্থিক কিংবা অন্য কোনো সুবিধা নিইনি।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন আজীবন সদস্য এবং নর্থ সাউথ ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

এদিকে গত ২০ আগস্ট বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে ২০২২ সালে পুনর্গঠিত ১২ সদস্যের বোর্ড পুনর্গঠন–সংক্রান্ত আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। তবে আদালতের স্থগিতাদেশের পরদিনেই দলবল নিয়ে নর্থ সাউথে যান পুরোনো বোর্ডের ট্রাস্টিদের কয়েকজন। নতুন করে দখলে নেয়া পুরোনো সেই বিওটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই বেশকিছু স্বেচ্ছাচরিতার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে গিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে উপাচার্য আতিকুল ইসলামকে ছয় তলা থেকে ফেলে দেয়াসহ নানা হুমকি প্রদান করেন পুরোনো ট্রাস্টসংশ্লিষ্ট কয়েকজন। এমনকি বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে চাকরি থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দিয়ে মোবাইলে মেসেজ পাঠান পুরোনো বিওটি সদস্য মোহাম্মদ শাহজাহান।

এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে নর্থ সাউথের শিক্ষকরা। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের অসম্মান করা ও ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ২১ আগস্ট বিকেলে কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। তাঁরা শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করেন। একপর্যায়ে তাঁরা শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দিতে ছাত্রছাত্রীদের উসকানি দেন।

আরও পড়ুন: নর্থ সাউথের আট ট্রাস্টির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে অনেকটা স্বেচ্ছাচারী উপায়ে উপাচার্য আতিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রবকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের পদে নিয়োগ দেয় বিওটি। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার পদে নিয়োগ ও নিয়োগ বাতিল করার এখতিয়ার একমাত্র রাষ্ট্রপতি বা আচার্যের। এমনকি উপাচার্য পদে রদবদলের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান একজনের ট্রাস্টির মালিকানাধীন ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা। যদিও নর্থ সাউথের নিজস্ব একটি জনসংযোগ বিভাগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে উপাচার্য আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসুস্থতাজনিত ছুটিতে রয়েছি। হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়ে এখন আমি বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছি। ইতোমধ্যে পুরোনো ট্রাস্টিদের অনেকের পক্ষ থেকে হুমকি পাচ্ছি। আমার নিয়োগ বাতিল বিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে পাইনি। সুস্থ হওয়ার পর ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরিকল্পনা রয়েছে।

উত্থাপিত দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন আমি ২ বছর ট্রাস্টিতে ছিলাম না। কি হয়েছে, কি হয়নি এগুলো এখন বলতে পারব না। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তাহলে বিস্তারিত কথা বলতে পারব—আজিম উদ্দিন আহমেদ, ২০২২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে ভেঙ্গে দেয়া ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান

সম্প্রতি দখল নেয়া আজিম উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বোর্ডের সদস্যদের কেউ কেউ দাবি করছেন শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে উপাচার্যকে সরানো হয়েছে। যদিও শিক্ষার্থীরা বলছেন ভিন্ন কথা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবী নিয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন দেখা গিয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের ১৪টি দাবি উপস্থাপন করেন। শিক্ষার্থীদের একজন আয়াত, যিনি পুরো আন্দোলনে মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। তিনি জানান, ‘আমরা ভিসিবিরোধী আন্দোলন কিংবা প্রশাসনিক পরিবর্তন নিয়ে সমর্থন দেইনি। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটি স্বার্থান্বেষী মহল অনেকগুলো বিষয়কে যুক্ত করছেন। আমরা শুধু শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি।’

এদিকে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত থেকেও পুনরায় ট্রাস্টি বোর্ডে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় ২০২২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে ভেঙ্গে দেয়া বিদায়ী বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘তারা (পুনর্গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড) কেন এসেছিল, কেনই বা পালিয়ে গেল আমি কিছুই জানি না।’ তবে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন আমি ২ বছর ট্রাস্টিতে ছিলাম না। কি হয়েছে, কি হয়নি এগুলো এখন বলতে পারব না। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তাহলে বিস্তারিত কথা বলতে পারব।’

আদালতের রায় ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিষয়ে কথা বলতে চাইলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পুনর্গঠিত বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেখুন, নর্থ সাউথ একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান। এটা দখল বা বেদখলের বিষয় নয়। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের আইন প্রদত্ত কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আমরা আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশনার বিষয়ে জেনেছি। সে আলোকে পরবর্তী আইনী পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা চাই, আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা হোক। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা। ক্যাম্পাসে গিয়ে অস্ত্র নিয়ে মহড়া, শিক্ষকদের চাকরি খাওয়ার হুমকি- এগুলো সভ্যজনের কাজ নয়।

যে কোন উপাচার্যের নিয়োগের ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ড মন্ত্রণালয়ের কাছে একটা প্যানেল পাঠায়। মন্ত্রণালয় সেটা আবার মঞ্জরি কমিশনে পাঠানোর পরে কমিশন এটাকে যাচাই-বাছাই শেষে পুনরায় মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সেখান থেকে শিক্ষাসচিব রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠালে সেখান থেকে নিয়োগ সম্পন্ন হবে। এটাই হলো প্রসিডিওর —ড. মো. ফখরুল ইসলামে, সচিব, ইউজিসি

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এম এ আউয়াল। যিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন আজীবন সদস্য এবং নর্থ সাউথ ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিষয়ে ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘আমি এখন আর নর্থ সাউথের খোঁজখবর রাখি না। আদালতের রায়ের মাধ্যমে যারা এখন পুনরায় ফিরে আসছেন তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই ২০১২ সালে আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাকে কিন্তু সরকার সরায়নি, তারা সরিয়েছিল।’

২০২২ সালে পুনর্গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডকে ইঙ্গিত করে এম এ আউয়াল বলেন, ‘যে ১২ জনকে দুর্নীতির কারণে অপসারণ করা হয়েছিল তাদের দুর্নীতি দেখে আমি তখন মামলা করছিলাম। সেই মামলার প্রেক্ষিতে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। কয়েকজনকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। ট্রাস্টিদের দুর্নীতির কারণে পরবর্তীতে সেসময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সুযোগ নিয়েছিল। মূলত আওয়ামী লীগ সুযোগটা নিয়েছে। পুনর্গঠনের ফলে যারা এসেছেন তারাও কেউ নর্থ সাউথের প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত না। যারা দুর্নীতি করছে তাদের সরিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের লোক বসিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে।’

ছবি: নর্থ সাউথ ইউনিভিার্সিটি (এনএসইউ)

আরও পড়ুন: পুনর্গঠন হচ্ছে নর্থ সাউথের ট্রাস্টি বোর্ড

প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠাকালীন বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন বিশিষ্ট আমলা ও কূটনীতিক অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিন। তৎকালীন আইন অনুযায়ী তিনিই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য ও প্রেসিডেন্ট। যদিও এত অবদান সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে কিংবা ওয়েবসাইটে মুসলেহ উদ্দিন বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্যই উল্লেখ নেই। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে গিয়ে তৎকালীন ফাউন্ডেশন সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে একপর্যায়ে তাকে নর্থ সাউথ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। নিজের লেখা একটি বইয়ে তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগও তুলে ধরেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি না থাকলে প্রোভিসি, প্রোভিসি না থাকলে ট্রেজারার ভিসির দায়িত্ব পালন করবেন। সেক্ষেত্রে ইউজিসিকে অবগত করতে হবে। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ইউজিসিকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু আমরা এনএসইউ থেকে উপাচার্য পরিবর্তন কিংবা ট্রেজারারকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে অফিসিয়াল কোন তথ্য পাইনি —মো: ওমর ফারুখ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক, ইউজিসি

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

তবে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামের সাথে এনএসইউর উপাচার্যকে সরানো এবং ট্রেজারারকে ভাপরপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে কথা হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমি শুধু এতটুকু জানি যে প্রফেসর আতিক, তিনি উপাচার্য ছিলেন এখন তিনি নেই। আমার কাছে এর বাইরে কোনো তথ্য নেই। অফিসিয়ালি কোনো তথ্যও আমরা পাইনি। তবে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যে কোন উপাচার্যের নিয়োগের ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ড মন্ত্রণালয়ের কাছে একটা প্যানেল পাঠায়। মন্ত্রণালয় সেটা আবার মঞ্জরি কমিশনে পাঠানোর পরে কমিশন এটাকে যাচাই-বাছাই শেষে পুনরায় মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সেখান থেকে শিক্ষাসচিব রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠালে সেখান থেকে নিয়োগ সম্পন্ন হবে। এটাই হলো প্রসিডিওর।

ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, এর বাইরে বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে উপাচার্যের দায়িত্ব দিতে চাইলে বিওটি সেটা করতে পারে। কিন্তু তার জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি আইনসিদ্ধ হওয়া সাপেক্ষে ইউজিসিকে অবগত করতে হয়। কিন্তু এনএসইউ কাকে নিয়োগ দিয়েছে এগুলো আমরা অফিসিয়ালি জানি না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডিভিশনকে অবগত করেছে বলেও আমার জানা নেই।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো: ওমর ফারুখের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি না থাকলে প্রোভিসি, প্রোভিসি না থাকলে ট্রেজারার ভিসির দায়িত্ব পালন করবেন। সেক্ষেত্রে ইউজিসিকে অবগত করতে হবে। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ইউজিসিকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু আমরা এনএসইউ থেকে উপাচার্য পরিবর্তন কিংবা ট্রেজারারকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে অফিসিয়াল কোন তথ্য পাইনি।


সর্বশেষ সংবাদ