পাবলিক নির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজেরারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগ একসময় রীতিতে পরিণত হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রীতির অনেকটাই অবসান ঘটেছে। বর্তমানে বেশকিছু স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজেরার, রেজিস্ট্রার এবং ডিনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নয় বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিগত কয়েকবছরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি), ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি), গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা।

এদের মধ্যে দেশের প্রথম মহিলা উপাচার্য কারমেন জেড লামাগনা অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশর (এআইইউবি) উপাচার্য হওয়ার আগে পার্পেচুয়াল হেল্প ইউনিভার্সিটির এবং এএমএ কম্পিউটার কলেজের ফ্যাকালিটি মেম্বার ছিলেন। আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব টেকনিক্যাল মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দশকের বেশি সময় অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের বর্তমান উপাচার্য কামরুল আহসান। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ভিনসেন্ট চ্যাং চীনের শেনঝেনে দি চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ে এবং ওমানের মাসকটে ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজিতে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন।

একই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আমরা প্রায় ১৫ জন এই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছি। এ পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা অংশ নিয়েছিল। পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাবলিকের কয়েকজন গ্র্যাজুয়েটও বাদ পড়েছেন। কিন্তু নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে ড্যাফোডিলের ৫ জন গ্র্যাজুয়েটসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন গ্র্যাজুয়েটই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।- মিজানুর রহমান, প্রভাষক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়

এছাড়া গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সামদানী ফকির ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ- উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তানভীর হাসান ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের রুজভেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। একই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে সেখানকার উপাচার্য হয়েছেন উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ইয়াসমীন আরা লেখা; এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।  

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. এইচএম জহিরুল হক ইউক্রেনের চেরকাসি স্টেট টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং খারকিভ স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব রেডিও ইলেকট্রনিক্সে শিক্ষকতা করেছেন। ড. জহিরুল এছাড়াও সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) অধ্যাপনা করেছেন। ইতিপূর্বে তিনি ইউল্যাবের উপ-উপাচার্য এবং উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিকের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়া হলেও বর্তমানে নিয়োগের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব পাচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরাও। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। 

ঢাবি ও বুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে একই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েই প্রভাষক পদে নিয়োগ পাচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এসব শিক্ষার্থী। সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদেরই একজন মো. মিজানুর রহমান। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। 

যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স বেড়েছে, সেখানে প্রভাষক থেকে পদোন্নতি পেয়ে অনেকেই অধ্যাপক হয়েছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে তারা উপাচার্য হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হয়েছেন। একারণে অন্য কোন নিয়মনীতিতে আটকাচ্ছে না এবং তারা সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হচ্ছেন। এককথায় আমরা বলতে পারি তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দিন বাড়ার সাথে সাথে মানসম্মত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে তারা আরো ভালো করবেন- অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মিজানুর রহমান বলেন, একই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আমরা প্রায় ১৫ জন এই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছি। এ পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা অংশ নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আমার সঙ্গে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাবলিকের কয়েকজন গ্র্যাজুয়েটও বাদ পড়েছেন। এতে ড্যাফোডিলের মোট ৫ জন গ্র্যাজুয়েট প্রভাষক হয়েছেন, অন্যরা ছিলেন বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগেও এখানকার অনেক গ্র্যাজুয়েট অধ্যাপনা করছেন বলেও জানান তিনি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ যোগ্য শিক্ষক এবং প্রশাসক তৈরি করছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সাথে পরীক্ষা দিয়ে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা অন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হচ্ছেন। তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছে বলে সেখানকার ফ্যাকাল্টি মেম্বার হচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, শুরুর দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকার সুযোগ ছিল না বিধায় উপাচার্যসহ প্রশাসনিক পদে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হতো। এখন যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স বেড়েছে, সেখানে প্রভাষক থেকে পদোন্নতি পেয়ে অনেকেই অধ্যাপক হয়েছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে তারা উপাচার্য হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হয়েছেন। একারণে অন্য কোন নিয়মনীতিতে আটকাচ্ছে না এবং তারা সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হচ্ছেন। এককথায় আমরা বলতে পারি তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দিন বাড়ার সাথে সাথে মানসম্মত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে তারা আরো ভালো করবেন।


সর্বশেষ সংবাদ