বাড়ছে বিসিএস প্রীতি, বদলে যাচ্ছে পেশা

পরীক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীরা
পরীক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীরা   © সংগৃহীত

মো. ইমরান হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। সদ্য প্রকাশিত ৪০তম বিসিএস এ শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে হয়েছেন ৭ম। মাঝে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর ৩৮তম বিসিএস এ যোগ দিয়েছিলেন জেলা সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে।

এমন ঘটনা শুধু ইমরানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ চাকরি প্রত্যাশী নিজেদের পেশা বদল করছেন। এ তালিকায় রয়েছেন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসা-প্রকৌশলীরাও। দেশের বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করছেন তারা। তবে তারা নিজেদের পেশায় যোগদান করছেন না বরং অন্য পেশায় আগ্রহী হচ্ছেন। এজন্য তারা পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রেখেছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পেশাকে। বিসিএস দেওয়ার মাধ্যমেই তারা পেশাবদল করছেন। 

সদ্য প্রকাশিত ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে ৭২, কৃষিতে ২৫০, পুলিশ ক্যাডারে ৭২, সহকারী সার্জন ১১২ ও পশুসম্পদে ১২৭ পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫ জনসহ মোট এক হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন।

আরও পড়ুন : পর্দা করতে সমস্যা, তাই চাকরি ছেড়েছেন সেই বিসিএস ক্যাডার

পিএসসি ও সুপারিশপ্রাপ্তদের সূত্রে জানা যায়, প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপদ, কাস্টমস, আনসার, খাদ্য ও ট্যাক্স ক্যাডারে প্রথম হওয়া সকলেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এরমধ্যে পাঁচজন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তিনজন এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে একজন সুপারিশ পেয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত কয়েকটি বিসিএস ধরেই পেশাবদলের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে ডাক্তার-প্রকৌশলীদের। তবে পেশাবদল নতুন কিছু নয়, অবাক করার বিষয় এই সংখ্যা দিনদিন বাড়ছেই। ক্ষমতা, আর্থিক সুবিধা ও সম্মানের কথা বিবেচনায় অনেকেই এই পেশাবদল করছেন।

তবে অধিকাংশ শিক্ষাবিদ বলছেন, বিসিএস নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত পেশাগুলোতেও তারা ভালো করবেন। কিন্তু যে শ্রম ও সময় দিয়ে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলেন, সেই বিদ্যা আর তাদের পেশাজীবনে সরাসরি প্রয়োগ হবে না বরং শ্রম, সময় ও রিসোর্সের এ এক অপচয়।

আরও পড়ুন: ছাত্রনেতা থেকে পুলিশ ক্যাডার শাস্ত্রী

পররাষ্ট্র ক্যাডারে ১ম হয়েছেন মোহাইমিনুল ইসলাম। মোহাইমিনুল শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পর ২০১২-১৩ সেশনে বুয়েটে ভর্তি হন। বাবা মোসলেম উদ্দিন আহমেদ জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আর মা আল্পনা বেগম গৃহিণী। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। বর্তমানে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়া মোহাইমিনুল ইসলামের এটিই ছিল প্রথম বিসিএস। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন তিনি। মোহাইমিনুল পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করার পর ২০২১ সালে ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রিমা মৃদুলাকে বিয়ে করেন মোহাইমিনুল।

পড়াশোনা চলাকালেই কাজী ফাইজুল করীমের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা থেকেই ৪০তম বিসিএসে আবেদনের সময় এক নম্বর চয়েসে কাজী ফাইজুল করীম দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার। সেই স্বপ্নই এখন সত্যি হয়েছে।

তিনি পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ছাত্র ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরি করছেন তিনি।

কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছেন ফাইজুল। এ ছাড়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তার বাবা আফতাব উদ্দিন একজন ব্যবসায়ী। মা কাজী মীর জাহান বেগম ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন : বিসিএসে বিবাহিতদের সফলতার অন্তর্নিহিত কারণ আছে

বর্তমানে চাকরির ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীরা ধুমরে-মুচড়ে পরছে বিসিএস এর দিকে। এর মূল কারণ সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা। বিসিএস এ সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় সুপারিশপ্রাপ্তদের অনেকেই অভিনন্দন বার্তা দিচ্ছেন। প্রশংসায় ভাসছেন সুপারিশপ্রাপ্তরা। তাদের সংগ্রাম ও পরিশ্রমের একাধিক দিক গণমাধ্যমে উঠে আসছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় এ নিয়ে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা।

কুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, পুলিশ ক্যাডারের চাকরির মূল্য ও সম্মান একজন ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি। এজন্য এই ক্যাডারকে লক্ষ্য করেই পড়াশোনা করেছি। এই ক্যাডারে সুপারিশ না পেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতেই যেতাম।

সদ্য প্রকাশিত ৪০তম বিসিএসে শুধু পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, ট্যাক্স, গণপূর্ত ক্যাডারেই নয়। অন্য ক্যাডারগুলোতেও ডাক্তার-প্রকৌশলীদের আধিপত্য বিরাজমান। এছাড়া কৃষিবিদরাও পেশাবদল করছেন।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ থেকে জানা যায়, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় এক লক্ষ ৭ হাজার ৬৪৮ টাকা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ লক্ষ ৯৪ হাজার ৬৬৩ টাকা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লক্ষ ৫১ হাজার ৪৬৩ টাকা, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি বার্ষিক ব্যয় ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৪৫৩ টাকা, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৭৫৪ টাকা ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ২৯৫ টাকা।

আরও পড়ুন : স্বামী প্রশাসনে ৭ম, স্ত্রী পুলিশ ক্যাডার

এর ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় সরকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করছে। তবে এ মেধার সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মেধাবীরা পেশাবদল করছেন।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে যাবে, পছন্দের ভিত্তিতে কর্ম বেছে নেবে। এই সুযোগটা তো আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কম। দেশে এমন কোনো নীতিমালা নেই, যে নীতিমালা অনুযায়ী ডাক্তাররা ডাক্তার পেশাতেই, প্রকৌশলী প্রকৌশলে, কৃষিবিদ কৃষিতেই থাকবেন। প্রতিবছর যেসব মেধাবীরা বের হচ্ছে তারা সেই সুযোগ না পেয়ে স্বভাবতই বিসিএসে ঝুঁকে পরছে।

আরও পড়ুন : তাক লাগিয়ে কনস্টেবল থেকে পুলিশ ক্যাডার হলেন হাকিম

তিনি আরও জানান, দিনদিন এই পরীক্ষা প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে। এর ফলে মেধাবীরা এই পেশায় সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হচ্ছে। এ নিয়ে কোন নীতিমালা নেই। সরকার যদি নীতিমালা করে দেয় কিংবা কোটাভিত্তিক করে দেয়; যে প্রকৌশল থেকে এতজন, মেডিকেল থেকে এতজন এই পেশায় আসতে পারবে, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও একটা সুযোগ তৈরি হবে। এখানে পেশার দিক থেকে দেখার সুযোগ কম।

এ সমস্যা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এখন আমাদের নীতিমালায়, পরিকল্পনায় এবং ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে গেছে। এই জায়গাগুলোতে অতিসত্বর সংশোধন, পরিমার্জন, নবায়নে বিশেষ বিবেচনা দিয়ে সমন্বয় করতে হবে। সকলে যাতে সুযোগ পায় এর একটা সুষ্ঠু নীতিমালা করতে হবে। না হলে এটা চলতেই থাকবে।


সর্বশেষ সংবাদ