তিন বছর ধরে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই কেএনএফ প্রতিষ্ঠাতা নাথানের

নাথান লনচেও বম ওরফে নাথান বম ও তার স্ত্রী লেলসমকিম বম (ডান দিক থেকে)
নাথান লনচেও বম ওরফে নাথান বম ও তার স্ত্রী লেলসমকিম বম (ডান দিক থেকে)  © সংগৃহীত

নাথান লনচেও বম ওরফে নাথান বম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং এর সশস্ত্র উইং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) প্রধান। তিনি ২০১২ সালে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনস বা কেএনডিও নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। যা পরে কেএনএফে রূপান্তরিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে নাথান বিভিন্ন কাজে নিজেকে জড়ানোর চেষ্টা করলেও সফলতা পাননি কোথাও। শেষে নানা মহলের সহযোগিতা নিয়ে গড়ে তোলেন সশস্ত্র সংগঠন।

তবে নাথানের এসব সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তার স্ত্রী লেলসমকিম বম কিছুই জানতেন না। নাথান পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার বিচারে পঞ্চম বম জনগোষ্ঠীর সদস্য। এই জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইডেনপাড়া সড়কে নাথানের পৈতৃক নিবাস। জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাথানের স্ত্রী জানান, তার স্বামীও কখনো এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেননি। নাথানের সঙ্গে তার তিন বছর ধরে যোগাযোগ নেই। তিনি এখানে আসেনও না।

তবে নাথানের স্ত্রী এখন চান তার স্বামী সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসুন। লেলসমকিম বম বলেন, আমি চাই, আমার স্বামী সুস্থ জীবনে ফিরে আসুন। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, তার যাতে কিছু না হয়।

লেলসমকিমের বড় বোনের মেয়ে টেরি বম বলেন, ইডেনপাড়ায় নাথান বম থাকেন না। তবে তার স্ত্রী ও সন্তান থাকেন। তিনি বলেন, নাথানের স্ত্রী স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্সের চাকরি করেন।

নাথানের স্ত্রী লেলসমকিম বলেন, ২০০৯ সালে তিনি নাথানকে বিয়ে করেন। নাথান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বেশির ভাগ সময় তিনি বিদেশে থাকতেন। বিশেষ করে ইউরোপের দেশ ইতালি, ফ্রান্স, হাঙ্গেরিসহ আরও কয়েকটি দেশে। সেখানে তার এক্সিবিশন হতো। একবার বিদেশে গেলে আট-নয় মাস পর আসতেন।

লেলসমকিম বলেন, ইডেনপাড়ায় কেএনডিও নামে একটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে নাথান জড়িত ছিলেন বলে তিনি জানতেন। সেখানে একটি লাইব্রেরিও আছে। ইডেনপাড়াতেই সংগঠনটির অফিস। এটা তৎকালীন সেনাবাহিনী উদ্বোধন করেছিল। এখন এটা পরিত্যক্ত। অফিসটি পাহাড়ের ঢালু জায়গায় ছিল। বর্ষাকালে পাহাড় ধসে অফিসটির পেছনের অংশ ভেঙে পড়ে। সাত-আট বছর হচ্ছে অফিসটি পরিত্যক্ত।

পাহাড়িদের একটি পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আবেদন করতে পারলেও ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি তিনি। ঘটনাচক্রে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীণ উপাচার্য ও বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এমাজউদ্দীন আহমদ একবার বান্দরবান সফর করে খিয়াং, লুসাই, ম্রো, বম জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দেন।

আর তাই পরীক্ষায় পাস না করতে পারলেও এমাজউদ্দীনকে ওয়াদা স্মরণ করিয়ে পিসিপি নেতারা নাথান বমকে চারুকলা অনুষদে ভর্তি করার সুপারিশ করেন। তাদের চাপে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।

নাথানের পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না কখনোই। তারপরও এই পরিবার এবং জনসংখ্যায় কম একটি জাতিগোষ্ঠীর ভেতর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়ার সুযোগ পাওয়া এলাকার অনেককেই গর্বিত করত। 

নাথান বম ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন। জেএসএস-সমর্থিত এই ছাত্রসংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও ছিলেন। এর পাশাপাশি নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে থাকতেন। খাগড়াছড়ির চেঙ্গি স্কয়ারে জেএসএসের প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আবক্ষ মূর্তি নিম্নী দেওয়ানের সঙ্গে তৈরি করেন নাথান বম। তবে একপর্যায়ে জেএসসের সঙ্গও ছাড়েন তিনি।

মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নাথানের পড়াশোনায় একাধিকবার বিঘ্ন ঘটে। তারপর শেষে স্নাতক হয়েছিলেন তিনি। এরপর যখন এলাকায় ফিরে যান, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর নেতৃত্বে ছিল জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। নাথান সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য বেশ তদবির করেছিলেন। কিন্তু এই কাজ তিনি পাননি। এটা তাকে বেশ ক্ষুব্ধ করে। 

চাকরি না পেয়ে নাথান একটি রিসোর্ট করে তোলেন পাড়ার কাছে। সেই ব্যবসা কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তাকে অনেকেই দেখেছেন ধর্মীয় বইপুস্তক নিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করতে। এসব করতে গিয়ে মিজোরামের কিছু ধর্মীয় গুরুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের সহায়তায় ইউরোপেও যান নাথান। সেখানে দুটি ডিপ্লোমা করেছেন বলে বন্ধুদের জানান। তবে অনেকেই এর সত্যতা সঠিক করে বলতে পারেন না। একপর্যায়ে তিনি বিয়ে করেন।

নাথান এখন কোথায়
কেএনএফের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ফলে শান্তিপ্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরে আসার কথা জানান শান্তি কমিটির নেতারা। এই কমিটির সদস্যসচিব জারলাম বম বলেন, জাতিসত্তার মানুষের দিকে চেয়ে সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে শুধু শান্তির জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয়ে গেল। শান্তিপ্রক্রিয়ার মাঝখানে কেএনএফ কেন এই কাজ করল, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

জারলাম বম জানান, গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে তার সঙ্গে নাথানের কথা হয়েছিল। নাথান তখন জানিয়েছিলেন, তিনি মিজোরামে আছেন। এরপর শান্তিপ্রক্রিয়ায় তিনি কেএনএফের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নাথানের সঙ্গে এরপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

নাথান কি সত্যিই মিজোরামে ছিলেন কখনো? এমন প্রশ্নের জবাবে বম জাতিগোষ্ঠীর এক প্রবীণ সদস্য বলেন, আমার মতো অনেকেই জানেন, নাথান মিজোরামের লংটলাই জেলার মুনাউন গ্রামে থাকতেন। এটা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। তবে নিশ্চিত করে কেউই কিছু বলতে পারছেন না।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বলিপাড়ার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তৈমুর হোসেন খান বলেন, নাথানের অবস্থান কোথায়, এটা আসলে নিশ্চিত করে বলা যায় না।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মিজোরাম শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নাথান বম কোথায় আছেন, সেটা আমরা অবগত নই। তবে এখন এত বড় বড় অপারেশন বাংলাদেশে হচ্ছে, সেখানে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বড় নেতা, অর্থাৎ নাথান যে কাছে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এটা ধরে নেওয়া যায়। কারণ, এত বড় অভিযানে মূল নেতা দূরে থাকবেন, এটা বোধ হয় ঠিক নয়।

 

সর্বশেষ সংবাদ