এক-দুই টাকা ঈদ সালামি পেলেই আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান
অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান  © টিডিসি সম্পাদিত

ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। তার ওপর এটি যদি হয়, ঈদ উল ফিতর তবে তো আর কথাই নেই। আনন্দ আর খুশির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। কারণ দীর্ঘ এক মাসের সংযম, ত্যাগ আর সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। শৈশব-কৈশরের ঈদ স্মৃতি ও ঈদ উল ফিতরের শিক্ষা, তাৎপর্য এবং বাস্তবতা নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলছেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাবিপ্রবি প্রতিনিধি আহসান হাবীব—

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন বাংলাদেশে ঈদের আনন্দ ও তাৎপর্য কতটুকু এবং সেটি কিভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: ঈদ আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশ্বাস ও অনুভূতির এক বিশাল উৎসব। ঈদ উল ফিতর বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আসে। রমাদানের পুরো মাসজুড়ে সংযম পালনের যে আত্মিক প্রশান্তি, তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ঈদের আনন্দে। তাই, আলহামদুলিল্লাহ্, দেখতে দেখতে রমাদানের সব রোজাই শেষ করছি। যদিও জানি না, রমাদানের মূল উদ্দেশ্য ও চাহিদাগুলো কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি! তবে, মনে প্রাণে চেষ্টা করেছি।

ঈদকে আমি অনুভব করি এক গভীর আবেগের সঙ্গে। এটি শুধু ব্যক্তিগত আনন্দ নয়, বরং আশপাশের মানুষের সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়ার এক অনন্য সুযোগ। বিশেষত, সমাজের সেই মানুষদের সঙ্গে, যারা বিভিন্ন কারণে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত—গরীব, দুঃস্থ ও সুবিধাবঞ্চিতদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারলেই ঈদ পূর্ণতা পায়। ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই প্রকাশিত হয়, যখন আমরা শুধু নিজের জন্য নয়, বরং অন্যের মুখেও হাসি ফোটানোর চেষ্টা করি।

গত ১৫-১৬ বছরের ঈদগুলো আমার কাছে আলাদা কোনো তাৎপর্য বহন করেনি। তবে, বাংলাদেশ এক নতুন সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে—একটি সময়, যা গড়ে উঠেছে দুই হাজারেরও বেশি শহীদের আত্মত্যাগ এবং হাজারো আহত মানুষের যন্ত্রণার বিনিময়ে। অনেক পরিবার তাদের আপনজন হারিয়েছে, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। আমরা যদি তাদের কষ্টকে উপলব্ধি করতে পারি, তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলে তবেই সেই আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব হবে।

এই ঈদ নতুন বাংলাদেশের এক নতুন আবহে এসেছে। ঈদের আনন্দ তখনই সত্যিকার অর্থে অর্থবহ হয়ে ওঠে, যখন আমরা নিজেদের সুখ-সুবিধার গণ্ডি পেরিয়ে অন্যদের মুখেও হাসি ফোটাতে পারি। আসুন, ঈদের এই আনন্দ ছড়িয়ে দেই সবার মাঝে, যেন সত্যিকার অর্থেই এটি আমাদের সকলের জন্য এক মহাউৎসব হয়ে ওঠে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার শৈশবের ঈদের স্মৃতি কেমন ছিল? 

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: শৈশবের ঈদে আজকের মতো এত বৈচিত্র্য ছিল না। আমি পারিবারিক ও অর্থনৈতিকভাবে বেশ সংকটের মধ্যে বড় হয়েছি। আমাদের পরিবারে কখনো অর্থের প্রাচুর্য ছিল না, তাই ঈদে সবসময় নতুন জামা কিনেছি তা মনে পড়ে না। তবুও ঈদ আমাদের জন্য এক বিশেষ আনন্দের দিন ছিল।

ঈদের দিনে হাতে মাত্র এক-দুই টাকা পেলেই আমরা প্রচণ্ড খুশি হতাম। মনে আছে, ঈদের পর ৫০ পয়সা দিয়ে বাদাম কিনতাম, আর পকেটভর্তি বাদাম নিয়ে বাসায় ফিরতাম—এতেই ছিল পরিপূর্ণ আনন্দ। সারাদিন ধরে খেলাধুলা আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকতাম। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, সবসময় প্রথম হতাম, তবুও খেলাধুলা কখনো বাদ দিতাম না। বিশেষ করে ডাংগুলি, মার্বেল আর চড়া খেলা ছিল আমাদের প্রিয় বিনোদন। সারাদিন মার্বেল খেলে প্রচুর মার্বেল জিততাম, তারপর সেগুলো বিক্রি করতাম। যদি সারাদিনে পাঁচ টাকার মার্বেল বিক্রি করতে পারতাম, সেটাই ছিল বিশাল আনন্দের বিষয়। এভাবেই শৈশবের ঈদ কেটে যেত।

আজ এসব স্মৃতি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। যদি শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম, তবে হয়তো আবারো সেই পুরোনো খেলাগুলো খেলতাম, সেই অভাবী বন্ধুগুলোর সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতাম। বর্তমানের ঈদ নতুনত্ব আর জৌলুসে ভরপুর। আজকের সন্তানরা ৫০০-১০০০ টাকা সালামি না পেলে খুশি হয় না, অথচ আমরা মাত্র এক-দুই টাকাতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ঈদের রূপও বদলেছে, কিন্তু আমাদের ফেলে আসা শৈশবের ঈদ এখনো মনে গভীরভাবে দাগ কাটে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদ কিভাবে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের আহ্বান করতে পারে?

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: আমি কখনো আমাদের অভাব বা পিছিয়ে থাকার বিষয়গুলোকে খারাপ কিছু মনে করি না। বরং অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলে আমরা অন্য মানুষের কষ্ট ও সংকটগুলো গভীরভাবে অনুভব করতে পারি। আমাদের ছাত্রবন্ধুদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে—বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানচর্চা কিংবা সার্টিফিকেটের ওজনে আমরা যত বড়ই হই না কেন, যদি সমাজকে নৈতিকতার ভিত্তিতে ধারণ করতে না পারি, তাহলে সমাজ পরিবর্তনের কর্ণধার হয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

আমরা হয়তো এখনো এই বাংলাদেশে সবার জন্য উপযুক্ত পোশাকের ব্যবস্থা, মানসম্মত শিক্ষা বা অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে যদি আমরা নীতিবোধসম্পন্ন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি, তাহলে একদিন জাপান ও সিঙ্গাপুরের মতো আমাদের দেশেও সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

আমরা এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারিনি। এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—সমাজ আমাকে কী দিচ্ছে, তার চেয়ে বড় বিষয় আমি সমাজকে কী দিচ্ছি? এই চিন্তাটি আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। আমাদের উচিত সবাইকে নিয়ে নতুন করে সমাজ গঠনে এগিয়ে আসা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জায়গাগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। শর্টকাট পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার প্রবণতা যত কমবে, ততই ঈদের আনন্দ আরও অর্থবহ হয়ে উঠবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: উপাচার্য হিসেবে প্রথম ঈদ। দায়িত্ব ও বাস্তবতা কোনটা প্রাধান্য দিচ্ছেন?

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: উপাচার্যের পদ আমার জন্য শুধু একটি পদ নয়, এটি এক বিশাল দায়িত্ব। আমি একে ক্ষমতা নয়, বরং দায়িত্বের বোঝা হিসেবেই দেখি। আমার লক্ষ্য একটাই—বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী বা কর্মচারী যেন আমার কারণে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন। এ নিয়ে আমি প্রতিনিয়ত ভাবছি, সচেষ্ট থাকছি।

আমার পরিবারের সদস্যরা বলেন, আমি এখন শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবি, অন্য কিছুতে তেমন মনোযোগ দিই না। সত্যিই, যখন অনেক মানুষের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি, তখন তাদের কল্যাণই আমার প্রথম ভাবনা। ফলে পরিবারের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ছে—বাজার করা, ঈদের কেনাকাটা, পারিবারিক সময় সবই ব্যস্ততার মাঝে চাপা পড়ছে।

আমি বিশ্বাস করি, সততা ও আদর্শের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারলে সামনে আমাদের ঈদগুলো আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। আমাদের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম যদি সংশ্লিষ্ট সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত হয়, তবেই আমি আত্মতৃপ্তি অনুভব করব। কারণ, দর্শনগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, আমার দায়িত্ব পালনের ওপর অনেক মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ নির্ভর করছে।

গত ১৬ বছরে অনেকেই বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এখন, যদি আমাদের কারণেও কেউ বঞ্চিত হন, তাহলে আমাদের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। তাই ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার প্রতি দৃঢ় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমার প্রধান লক্ষ্য।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদ নিয়ে মন খারাপের একটি স্মৃতি শেয়ার করবেন?

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ঈদ ছিল এক দুঃখভারাক্রান্ত অভিজ্ঞতা। ভর্তি হওয়ার পর দীর্ঘ নয় মাস পর্যন্ত বাড়ি যেতে পারিনি, আর এর প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক সংকট। আমি তখন টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতাম এবং পরিবারের ওপর নির্ভর না করার চেষ্টা করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সেই চাপ আরও বেড়ে গিয়েছিল, তাই বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরির দিকে মনোযোগ দিই।

ঈদের সময়ও একাধিক টিউশনের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ঈদের এক সপ্তাহ পরেই আমার পরীক্ষা ছিল, পাশাপাশি আমার টিউশনের ছাত্রেরও পরীক্ষা ছিল। এই দুই কারণে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ফলে, একাই ঈদ পালন করতে হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ নয় মাস পর বাড়ি ফিরেছিলাম, যা ছিল ভীষণ কষ্টের একটি সময়।

আজ যখন সেই সময়ের কথা ভাবি, তখন মন খারাপ হয় ঠিকই, তবে বুঝতে পারি—সেই কষ্টই আমাকে জীবনের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা শিখিয়েছে। কঠিন সময়ই হয়তো নতুন অভিযোজনের সুযোগ তৈরি করে দেয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদে আপনার বিশেষ অভ্যাস ও অনুভূতি আছে কিনা?

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: আমি নির্দিষ্ট কোনো প্রথা অনুসরণ করি না, বরং ধর্মীয় আচার ও বিধানগুলোকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে ঈদের দিনে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়, তা হলো সমাজের অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো। আমি যেখানে থাকি না কেন, চেষ্টা করি অর্থনৈতিক, জ্ঞান, বুদ্ধি বা সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে থাকা মানুষদের কাছে যেতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা, তাদের নাম ধরে ডাকতে আমার আলাদা ভালো লাগে। ঈদের দিন এটি আমি আরও বেশি করে করি, কারণ এ থেকেই আনন্দ পাই। আমি মনে করি, ঈদ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি মানসিক প্রস্তুতির বিষয়। ঈদ এলেই মানুষের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মেশার, তাদের অনুভূতি ভাগাভাগি করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এটাই আমার ঈদের বিশেষ উপলব্ধি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রাবিপ্রবি পরিবারকে ঈদ শুভেচ্ছায় কী বার্তায় কী জানাবেন?

অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান: রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানাই। ঈদ আমাদের জন্য আনন্দ, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক ভালোবাসার এক মহৎ উপলক্ষ।

আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যারা দূর-দূরান্তে নিজ নিজ বাড়ির পথে রওনা হয়েছে, তারা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাক এবং সুস্থভাবে আবার ফিরে আসুক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সবার ঈদ আনন্দময় হোক, অর্থবহ হোক।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence