বিভাজনের বাইরে গিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে হবে

অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দীন খান
অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দীন খান  © টিডিসি ফটো

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর অন্যায়ভাবে চালানো দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের। এ সংগঠনটির হয়ে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বেশ জোড়ালো ভূমিকা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দীন খান। বিপ্লব পরবর্তী অস্থিরতা, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপার ও ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জিৎ দে। অনুলিখনে তার চৌম্বক অংশ তুলে ধরেছেন ঢাবি প্রতিনিধি মুহাইমিনুল ইসলাম-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কোন পথে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক?

ড. তানজীমউদ্দীন খান: আমরা ভারতীয় হিন্দি ছবি দেখছি, ভারতীয় নাটক দেখছি, ভারতে বাংলা চ্যানেল যেগুলো আমরা নিয়মিত দেখছি। ভারত বিরোধিতা আমি যেভাবে বোঝার চেষ্টা করি সেই অর্থে ভারতের শাসক গোষ্ঠীর সাথে আমাদের সাধারণ মানুষের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কের সাথে একটা দূরত্ব ও বৈরিতা তো আছেই। আমাদের কিছু ন্যায্য বিষয়- বিশেষ করে তিস্তা পানি বণ্টন, বিএসএফ সদস্যদের সীমান্ত হত্যা এবং এরকম আরো বেশ কিছু টেনশন আছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে। এটার মানে এই না যে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখে। সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক একই রকম কিন্তু এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো শাসকগোষ্ঠী। ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর যে দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সেটা হচ্ছে সংকটের জায়গা। সম্প্রতি বাঁধ খুলে দেয়া নিয়ে আলোচনাটা ফের জোরালো এসেছে। ভারতেও কিন্তু ব্যাপক বন্যা হচ্ছে। ওখানে একটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ধসে পড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এটা অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু যারা ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী আছেন বাংলাদেশের স্বার্থ বা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা বা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রেন যেমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত ছিল তেমনটি আসলেই প্রতিফলিত হয়নি। যে কারণে বাংলাদেশের জনগণের ভারতের শাসক গোষ্ঠীর প্রতি হয়তো বিরাগ থাকতে পারে। আমরা গত ১৫-১৬ বছর, ২০০৮ সালের পর থেকে যে নির্বাচনগুলো দেখেছি সেগুলো বিতর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনগুলো হয়েছে কিনা সঠিকভাবে সেটা নিয়ে সবাই সন্দিহান। অনেকেই বলছেন আসলে নির্বাচন হয়নি। সে জায়গায় একটা গণতান্ত্রিক দেশের শাসকগোষ্ঠী হিসেবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনগুলোতে সমর্থন দেয়া অনেককেই হতাশ করেছে।  

এর থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে, যেই ধরনের রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হন সেই রাজনীতিটা খুবই সমস্যাজনক। তাদের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আত্মপরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতি। এ আত্মপরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতি হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি। এই বিভাজনের রাজনীতি একে অপরকে বিদ্বেষমূলক করে তোলে, একে অপরের প্রতি শত্রুতা তৈরিতে সাহায্য করে। ওই জায়গা থেকে সামগ্রিকভাবে সবাই যদি বেরিয়ে আসতে পারি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে বৈশিষ্ট্য সেই বৈশিষ্ট্যে যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে এই পরিস্থিতির খুব সহজে উন্নয়ন ঘটবে না। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিপ্লব পরবর্তী এই অস্থিরতা থেকে মুক্তির উপায় কী?

ড. তানজীমউদ্দীন খান: আমাদের একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল পর্যন্ত এমনভাবে দলীয়করণ হয়েছে তাতে ওই দলটা না থাকার কারণে তারাও কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকতে পারছেন না। একটা নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। নেতৃত্বশূন্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্ষোভ কোথায় প্রকাশ করবে কিংবা তাদের অভিযোগগুলো কোথায় জানাবে সেটা অজানা। ফলে আমরা কখনো কখনো দেখছি তারা অনেক বেশি অরাজক হয়ে উঠছেন যেটা আসলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এমন পরিস্থিতি যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর এবং এই ধরনের অরাজকতা বা প্রবণতাকে আমাদের এখনই থামাতে হবে। তা না হলে একটা দল ক্ষমতা থেকে চলে গিয়ে আরেকটা দল ক্ষমতায় আসলে এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হতেই থাকবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল পর্যন্ত যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে দ্রুতই এই শূন্যতাগুলো পূরণ করে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে একটা স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা লিখিত অভিযোগগুলো সেখানে জমা দেবে। সেই কমিটি অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, দেশের আইন অনুযায়ী বা তাদের প্রতিষ্ঠানের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।  সেজন্যই প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা আনা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে আপনার মতামত কী? 

ড. তানজীমউদ্দীন খান: আমি একটা ঘটনা বলি, যখন আমি মুহসিন হলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমি একটা ব্যানার দেখলাম; সেই ব্যানারে লেখা এখন থেকে এই হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। নিচে ছোট করে আবার লেখা এখন থেকে জোর করে কোন ছাত্রকে গেস্ট রুমে নেয়া যাবে না, কোন পলিটিক্যাল প্রোগ্রামে নেয়া যাবে না। এই বাক্যটি থেকে কিন্তু স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে ওরা আসলে কী ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়েছে। যেই রাজনীতিটা আমরা দেখেছিলাম যেখানে ছাত্রদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে সেই রাজনীতি বিরোধিতা করছে তারা। এখন যদি ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলি, তাহলে সেটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় যে আমরা আসলে বিরাজনীতিকরণের  কথা বলছি কিনা। আজকে যে ঘটনাটা ঘটলো এই যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘটল- এটা  আসলে রাজনীতির বাইরের কিছু কিনা। এটা ভিন্ন রাজনীতি । সনাতনী রাজনীতির বিপরীতে গিয়ে একটি নতুন রাজনীতির সূচনা। রাজনীতি কখনোই মানুষের স্বার্থবিরোধী হতে পারে না। শুধু শক্তির চর্চা করলেই সেটা কিন্তু রাজনীতি হয় না, সেটা শক্তিনীতি। এখন রাজনীতিকে কেউ যদি শক্তিনীতি হিসেবে বোঝে তাহলে সে রাজনীতি অবশ্যই বর্জনীয়। কিন্তু রাজনীতি যদি মানুষের স্বার্থে হয় কেননা আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও কিন্তু রাজনীতির প্রয়োজন। কারণ আমার রাজনৈতিক এসফেয়ার আছে,পাবলিক স্পিচ আছে। এখানে আমি আমার অধিকারের কথা বলতে পারি, আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করতে পারি। এখন সেই ক্ষেত্রে যদি আমরা ঢালাওভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলি তাহলে আমরা যেই উদ্দেশ্যে বলছি নতুন রাজনীতির সূচনা ঘটবে সেই উদ্দেশ্য থেকে কিন্তু আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমরা পুরোনো রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ভাবে রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করতে চাই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা প্রগতিশীল হতে পারবে?

ড. তানজীমউদ্দীন খান: আজকে যে সমস্যাগুলো আসছে সে সমস্যাগুলো আমরা কেন সমাধান করতে পারিনি তার কারণগুলো দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল নেতৃত্বই হচ্ছে মাননীয় উপাচার্যের। কিন্তু উপাচার্যেরই যদি শিক্ষা ও গবেষনা নিয়ে ভিশন না থাকে তাহলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। উপাচার্য নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগের সময় কি সরকার সম্ভাব্য উপাচার্যকে ডেকে তাঁর চিন্তা ও ভিশন জিজ্ঞেস করেন। তাকে কি জিজ্ঞেস করা হয়- আপনাকে যদি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে আগামী পাঁচ বছরে বা চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনি কোথায় দেখতে চান। এই প্রশ্নটা তাকে কখনও করা হয় কিনা বা এই ভিত্তিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় কিনা। সেটা তো আমার আসলে কখনও দেখি না। একজনের প্রশাসনিক ও একাডেমিক যোগ্যতা যাই থাকুক বা না থাকুক আমরা ঐতিহাসিক ভাবেই দেখেছি যে শুধু গত ১৫ বছরই না এর আগেও যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছেন তারা চেয়েছেন যে তার অনুগত কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া। এ জায়গাটাতেই সংকট তৈরি হয়। তার মানে উপাচার্য নিয়োগ হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক মানুষটাকে যদি বিবেচনা করা যায়, সঠিক মানুষটাকে যদি আনা যায় তাহলে আমরা অনেক সংকটই খুব সহজেই অতিক্রম করতে পারব। যতই একাডেমিক যোগ্যতা থাকুক, যতই  প্রশাসনিক দক্ষতা থাকুক তার যদি ভিশন বা স্বপ্নটা না থাকে তাহলে বোধহয় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারছি না। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশ এখন কোন পথে আছে?

ড. তানজীমউদ্দীন খান: আমরা একইসাথে সম্ভাবনাময় ও অস্থিরতাপূর্ণ সময় পার করছি। আমরা জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে। এটাকে আমি বিপ্লব বলি না অনেক কারণেই। এটা একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। কোন অভ্যুত্থানের পরে যে অবস্থা হয় এটা খুব অস্বাভাবিক বাস্তবতা না, খুবই স্বাভাবিক বাস্তবতা। পৃথিবীর সব দেশেই এরকমটা হয়। এই ধরনের গণঅভ্যুত্থানের পরে। এই গণঅভ্যুত্থান কোন রাজনৈতিক দলকে ঘিরে হয়নি। একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে নৃশংসতার প্রেক্ষিতে মানুষ নিজেকে বাঁচানোর জন্য সবাই একত্রিত হয়েছে এবং সব ধরনের মানুষ এক ধরনের ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। তারমানে এক ধরনের একতা এখন আমাদের ছাত্র-জনতার মাঝে বিরাজ করছে। 

খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই একতাটাকে আমরা মাথায় রেখে এবং এই রাষ্ট্র সংস্কার কিংবা রাষ্ট্র মেরামতের যে প্রসঙ্গটা আসছে তাতে মনোযোগী হওয়া। কোটা সংস্কার থেকে এখন রাষ্ট্র সংস্কার। এই স্পিরিটটা ধারণ করে সবাই যেন সবার প্রতি সহযোগী হই, সবার প্রতি যেন সহিষ্ণু হই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে সহিষ্ণুতার ভয়ানক অভাব। সবাই সবাইকে শত্রু তৈরি করি, সবাই সবার সাথে বিভাজন তৈরি করে নিজেরটা পেতে চাই। সেটার জন্য সবাই সবার সাথে সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা এবং ভালোবাসার সমন্বয় খুবই প্রয়োজন। এগুলোকে অনুধাবন করে আমরা সবাই বাংলাদেশকে একটি নতুন বাংলাদেশ হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাব সেটাই হচ্ছে আমাদের সকলের কামনা। 

ভিডিওতে দেখুন সাক্ষাৎকারটি: 


সর্বশেষ সংবাদ