এখন যৌতুকের ব্যবহার হচ্ছে উপহার ও মেয়ের অধিকারের নামে

মো. ইসতিয়াক
মো. ইসতিয়াক  © টিডিসি ফটো

বর্তমান সমাজে যৌতুক এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি কিন্তু কিছু কিছু মানুষের কাছে যৌতুক একপ্রকার উপহার হিসেবে গণ্য করা হয়। বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে অনেক নারী যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হন। অনেক সময় ঘটনা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়।

যৌতুকের কারণে কখনো কখনো সংসারজীবনে নেমে আসে অশান্তি। সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রমও হয়ে থাকে। সমাজে প্রভাব বিস্তার করা অন্যতম এই অপরাধ সম্পর্কে আইনে কি বলা হয়েছে এবং এর শাস্তি কি সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছি।

যৌতুকের সংজ্ঞা
সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় কনেপক্ষের কাছ থেকে ছেলে পক্ষের আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা নেওয়াকে বোঝায়। এই সুবিধা নেয়ার বিষয়টি বিয়ের পরেও ঘটতে পারে। তবে আইনে বিয়ের শর্ত হিসেবে বর বা কনেপক্ষের দাবি-দাওয়াকে যৌতুক বলে।

যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়ার চর্চা হয়ে আসছে। যৌতুকের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে, তার ইতিহাস স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, যে সময় সমাজে নারীর কোনো মূল্য ছিল না, পণ্যের মতো তাদের কেনা-বেচা করা হতো, এমনকি বিয়ের সময় ছেলে পক্ষকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করে বিয়ে দেওয়া হতো, সেই সময়েই যৌতুকের আবির্ভাব ঘটে। 

যৌতুক বন্ধে বাংলাদেশে ‘যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮’ রয়েছে। এই আইনের ২ ধারার অধীনে যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যৌতুক হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের কাছে দাবি করা অর্থসামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ। এ দাবি বিয়ের আগে, পরে বা বিয়ের সময়—যখনই হোক না কেন, তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে। তবে মুসলমানদের ক্ষেত্রে দেনমোহর যৌতুক বলে গণ্য হবে না। আবার বিয়ের আসরে অতিথিরা নিজের ইচ্ছায় উপহার প্রদান করলেও তা যৌতুক নয়।

যৌতুকের মামলায় বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে
অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদের পর দেনমোহরের মামলার পাশাপাশি যৌতুকের মামলা করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু যৌতুকের মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে। বিচ্ছেদের পর অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে বাধা নেই। তবে যৌতুকের মামলার জন্য বিবাহ বলবৎ থাকা জরুরি। 

এ ব্যাপারে মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুম জিনাল আরা বনাম শাহিদুল এবং অন্যান্য ২ এলএনজে (২০১৩) এইচসিডি ২৩৫ মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ) ধারার অধীনে করা হয়। অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করা হয়েছে বলে মামলাটি করা হয়। আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, মামলাটি করার আগে পক্ষদ্বয়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে এবং বিচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, বিচ্ছেদের পর যৌতুকের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

যৌতুকের মামলা কাদের বিরুদ্ধে হয়?
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ২(খ) ধারায় যৌতুকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয়, যৌতুক যে সর্বদা বরপক্ষ দাবি করবে, তা নয়। কনেপক্ষ বিয়ের শর্ত হিসেবে দেনমোহর ব্যতীত অন্যান্য অর্থসম্পদ দাবি করলেও তা যৌতুক এবং এর জন্য প্রচলিত আইনের অধীনে আদালতে মামলা করা যায়। আইনের এ ধারার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মামলা দেখা গেছে যেখানে স্বামী তার স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করেছেন। মামলার ফলে স্ত্রী ও তার আত্মীয়স্বজন আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন। সুতরাং যেকোনো পক্ষই বিয়ের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত ধনসম্পদ দাবি করলে তা যৌতুক হবে এবং যৌতুক দাবি করায় অপরাধী বলে গণ্য হবেন।

যৌতুকের সাজা
যেহেতু যৌতুক দেওয়া-নেওয়া ও দাবি করা গুরুতর অপরাধ, সেহেতু আইনে এ অপরাধের জন্য সাজা বা দণ্ডের উল্লেখ আছে। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে যৌতুক দাবি, প্রদান ও গ্রহণ করার দণ্ড হচ্ছে অনধিক পাঁচ (৫) বছর; কিন্তু অন্যূন এক (১) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। যে ব্যক্তি যৌতুক দেওয়া বা গ্রহণ করার ব্যাপারে সহায়তা করবেন, তিনিও একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

রাষ্ট্র বনাম সানোয়ার হোসেন জোয়ারদার, ২ এলএনজে (২০১৩) এইচসিডি ৪৬২ মামলায় আদালত মতামত প্রদান করেন, আসামি যে খুনের সঙ্গে জড়িত তার পুরোপুরি নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সেই খুন যদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারার অধীনে হয়েছে বলে প্রতীয়মান না হয় তাহলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অধীনে আসামির বিচারকার্য পরিচালিত হবে এবং দণ্ডিত করা যাবে। 

কোন ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ ধারার অধীনে মামলা করা যাবে তা বিশ্লেষণের জন্য আরেকটি মামলা উল্লেখ করা যায়। রাষ্ট্র বনাম এ আউয়াল ৪ এলএনজে (২০১৫) এইচসিডি ১৯০ মামলায় বলা হয়, স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক যৌতুকের দাবিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারার অধীনে মামলা করার পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হবে; অর্থাৎ ১১(ক) ধারায় মামলা করার জন্য যৌতুকের দাবিই যথেষ্ট।

যৌতুকের ফলে নির্যাতন ও মৃত্যু ঘটানোর শাস্তি
বর্তমানে  পত্রিকার পাতাই প্রায়ই শিরোনামে দেখা যায় যে ‘যৌতুক দিতে না পারায় মৃত্যু’ বা ‘যৌতুকের চাহিদা মেটাতে না পারায় নববধূ খুন’ বা বিবাহ বিচ্ছেদ। এ থেকে স্পষ্ট, আমাদের সমাজে যৌতুক এমন চরম আকার ধারণ করেছে যে এর দাবি মেটাতে অস্বীকার করলে নির্যাতন থেকে শুরু করে খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। 

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ (সংশোধিত)-এর ১১ (ক) ধারায় বলা হয়েছে যে যদি যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু ঘটানো হয় তাহলে তার জন্য সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে তার জন্য শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ১১ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম হলে দোষী ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১২ বছর; কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। 

এছাড়া ১১ (গ) ধারাতে  বলা হয়েছে যে যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম হলে দোষী ব্যক্তি অনধিক তিন বছর, কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডেও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন  আইনের ১১ ধারার অধীনে সাজার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে যে মৃত্যু, সাধারণ জখম ও মারাত্মক জখম যৌতুক প্রদানে অস্বীকৃতির কারণে ঘটানো হয়েছে। যৌতুক-সংক্রান্ত ঘটনা ব্যতীত অন্য কোনো কারণে ঘটানো হলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির অধীনে তার বিচার হবে।

মিথ্যা যৌতুক মামলার সাজা
যৌতুককে কেন্দ্র করে  যেমন নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে আবার যৌতুক-সংক্রান্ত মিথ্যা মামলার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কিছু অসাধু মানুষ যৌতুক নিরোধ আইনটিকে প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে কিছু ব্যক্তি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন এবং  হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এই মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পাও্য়ার জন্য ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো আইনানুগ কারণ নেই জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা বা অভিযোগ করেন তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 

আবার ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির অধীনেও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলা করলে তার জন্য শাস্তি হবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। তবে মামলার ধরন যদি এমন হয়, যার জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছরের অধিক কারাদণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল তাহলে মিথ্যা মামলাকারীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে যৌতুকের ফলে নির্যাতন কমেছে। ২০২২ সালে যৌতুকের ফলে ১২৩টি কেস ফাইল করা হয়। ২০২৩ (জানুয়ারী–নভেম্বর ) সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায়  ৮৭-তে ।

যৌতুকের ফলে নির্যাতনের  ঘটনা কিছুটা কমেছে কিন্তু এই খবর আমাদের স্বস্তি দেয় না। বিয়ের সময় যৌতুক নেওয়ার মানসিকতা সংখ্যাগতভাবে কমেছে। এটা হতে পারে যৌতুক চাওয়ার ধরন পাল্টে যাওয়ার কারণে। এখন উপহার ও মেয়ের অধিকার এসব কথা বলে পারস্পরিক বিনিময় চলে আসছে। 

কিন্তু বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ সময় পার করার পর যৌতুক চাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এতে করে নির্যাতনও বেড়েছে। ফলে স্ত্রীর আইনি প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা  কমেছে। ফলে যৌতুকবিরোধী সামাজিক প্রতিরোধের ধরন বদলানো জরুরি। বিয়ের আগের যৌতুক চাওয়া নিয়ে সমাজকে সচেতন করা গেছে। কিন্তু দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের পর এ ধরনের ঘটনার প্রতিরোধ নিয়ে তেমন কোনও কাজ নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ