আতঙ্ক ছড়ানো নতুন ভাইরাস এইচএমপিভি সম্পর্কে যা জানা গেল

এইচএমপিভি ভাইরাসের দৌরাত্ম্য বেড়েছে চীন ও জাপানে
এইচএমপিভি ভাইরাসের দৌরাত্ম্য বেড়েছে চীন ও জাপানে  © সংগৃহীত

নতুন ভাইরাস এইচএমপিভি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পাঁচ বছর আগে যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল বিশ্বকে, আবারও সে রকম কিছু হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করেছেন নেটিজেনদের একাংশ। বিভিন্ন মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের দৌরাত্ম্য বেড়েছে চীন ও জাপানে।

সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, চীনের হাসপাতালগুলোতে হঠাৎ করে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর উপচে পড়া ভিড়। বলা হচ্ছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা এ, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া ও কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাবই দেশটিতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত সমস্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ।

অবশ্য চীনের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ‘শীতজনিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ হিসেবে অভিহিত করে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত সমস্যা সাধারণত শীতের মৌসুমেই বাড়তে দেখা দেয়।

হাসপাতালগুলোতে ভিড় এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ বৃদ্ধিজনিত প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রোগগুলো তুলনামূলক কম মারাত্মক এবং গত বছরের তুলনায় ছোট পরিসরে ছড়িয়েছে। তিনি নিজ দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের প্রতি চীনের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ প্রশাসনের (সিডিসি) জারি করা নির্দেশিকা মেনে চলার আহ্বান জানান।

২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসের গবেষকরা শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের নমুনা পরীক্ষা করার সময় প্রথম এই ভাইরাস আবিষ্কার করেন। অবশ্য গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসটি অন্তত ছয় দশক ধরে বিদ্যমান।

ভাইরাসটির ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’ তিন থেকে পাঁচদিন, অর্থাৎ কেউ এতে সংক্রমিত হলে তিন থেকে পাঁচদিনের মধ্যে তার দেহে এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।

এই ভাইরাস মানবদেহে সাধারণ সর্দি-কাশির মতো লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হওয়া, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে এটি ব্রংকাইটিস ও নিউমোনিয়ার কারণও হতে পারে। কিছুক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে চামড়ায় র‍্যাশও দেখা যায়।

এইচএমপিভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণত খুবই দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখায়। ফলে পুনরায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না। যদিও সারাবছরই মানুষের এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তবে সাধারণত শীত ও বসন্তকালেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি শনাক্ত হয়।

কীভাবে ছড়ায়, ঝুঁকিতে কারা
এইচএমপিভি মূলত হাঁচি ও কাশির মাধ্যমেই ছড়ায়। সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। পাশাপাশি এই ভাইরাসে সংক্রমিত কোনও কিছু যেমন, খেলনা বা দরজার হাতল স্পর্শ করার মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে।

এ ছাড়া এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে–এমন পরিবেশে থাকার কারণেও যে কেউ এইচএমপিভিতে সংক্রমিত হতে পারে।

এইচএমপিভিতে প্রধানত শিশু, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা ব্যক্তি ও বয়স্করা বেশি সংক্রমিত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এইচএমপিভি সংক্রমণের বেশিরভাগ ঘটনা ৫ বছর বা তার কম বয়সীদের মধ্যে ঘটে, যাদের মধ্যে ৫ থেকে ১৬ শতাংশ শিশু নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ যেমন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।

যদিও হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা এমফাইসেমার মতো ফুসফুসের রোগের ইতিহাস থাকলে এইচএমপিভি-তে তা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায় না, তবে একবার এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে তা শারীরিক এই ধরনের সমস্যাগুলোর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

কেমোথেরাপি নেওয়া বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের মতো যাতের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

যেসব ব্যক্তি আগে থেকেই বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছে, এইচএমপিভির সংক্রমণ তাদের মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।

ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের ২০২১ সালের একটি নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মারা যাওয়া ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের এক শতাংশের মৃত্যুর জন্য এইচএমপিভি দায়ী।

প্রতিরোধের উপায় কী
বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর এই ভাইরাস প্রতিরোধে কয়েকটি টিকা তৈরি করা হলেও এইচএমপিভি প্রতিরোধ এখনও সে ধরনের কোনও টিকা নেই।

অবশ্য এইচএমপিভির সংক্রমণে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হওয়ার মতো ঠান্ডাজনিত যেসব লক্ষণ দেখা যায়, তা সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়।

গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাধারণত লক্ষণ বুঝে তা উপশমের চেষ্টা করে থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ ব্যবহার করে লক্ষণ উপশমের চেষ্টা করেন। নাক বন্ধ হওয়ার সমস্যা কমাতে ডিকনজেস্ট্যান্টও ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রে।

সিওপিডি, অ্যাজমা ও পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগীদের মাঝে সংক্রমণের লক্ষণগুলো গুরুতর আকারে দেখা দিতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট ও কাশি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।

সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংহাইয়ের একটি হাসপাতালের এক শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ এইচএমপিভির সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের অযথা ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।

তথ্যসূত্র : এনডিটিভি ও হিন্দুস্তান টাইমস


সর্বশেষ সংবাদ