৩০০ ফোন ও ১০০ ল্যাপটপ ছিনতাই: সাত বছরেও বিচার পাননি যবিপ্রবির ভুক্তভোগীরা

শহীদ মসিয়ূর রহমান হলে ভাংচুর করা কক্ষ
শহীদ মসিয়ূর রহমান হলে ভাংচুর করা কক্ষ  © ফাইল ছবি

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে আছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) হলে ডাকাতির ঘটনা। ২০১৭ সালের আজকের (৫ অক্টোবর) রাতে নির্মমতার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়টির শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম শমীম হাসানের নেতৃত্বে তার অনুসারী ও যশোর শহরের প্রায় ৩০-৪০ জনের বহিরাগত মুখোশ পরে হলে ডাকাতি করে প্রায় ৪২ লাখ টাকার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও নগদ অর্থ লুটে নেয়। 

এদিন তারা আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনায় যবিপ্রবিয়ানদের কাছে কালরাত হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনায় ৭ অক্টোবর শামীম হাসানকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে ঘটনার পর দীর্ঘ ৭ বছরেও বিচার হয়নি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসানের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় গ্রুপ (লবিং) পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। কমিটির শুরু থেকেই সুব্রত ও শামীম যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাইফুর রহমানের গ্রুপের অনুসারী ছিলেন। ২০১৪ সালে যবিপ্রবি ছাত্র নাইমুল ইসলাম রিয়াদ হত্যা মামলার আসামি হয়ে দু’জন একসঙ্গে জেলও খেটেছেন। 

২০১৭ সালের প্রথম দিকে শামীম কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় লবিং পরিবর্তন করে এমপি কাজী  নাবিল ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের অনুসারী হন। ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। ওই বছরের মে মাসে ক্যাম্পাস থেকে শামীম গ্রুপকে বিতাড়িত করে সুব্রত বিশ্বাস। ফলশ্রুতিতে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যবিপ্রবিতে ঘটে হল ডাকাতির মত ন্যাকারজনক এ ঘটনা।

কেড়ে নেওয়া হয় প্রায় ১০০ ল্যাপটপ, ৩০০ মোবাইল ফোনসহ নগদ অর্থ। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ক্ষতি হয় প্রায় ৪২ লাখ টাকার সম্পদ। একপর্যায়ে রাত ৩টার দিকে পুলিশের সহায়তায় ট্রাক নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে যায় অপরাধীরা।

২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর। রাত সাড়ে ১১টা। ছাত্রলীগ নেতা শামীম হাসানের নেতৃত্বে বহিরাগত ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী মিলিয়ে ৩০-৪০ জনের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। প্রধান ফটকে থাকা আনসারদের মারধর করে ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ফোন। এরপর সোজা প্রবেশ করে মসিয়ূর রহমান হলে। এ সময় তারা কয়েক রাউন্ড গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ করে ত্রাশ সৃষ্টি করে। 

পাঁচতলা বিশিষ্ট হলের প্রতিটি কক্ষে চলে তল্লাশি। শিক্ষার্থীদের ওপর রড জিআই পাইপ দিয়ে চলানো হয় নির্যাতন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কেড়ে নেওয়া হয় প্রায় ১০০ ল্যাপটপ, ৩০০ মোবাইল ফোনসহ নগদ অর্থ। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ক্ষতি হয় প্রায় ৪২ লাখ টাকার সম্পদ। একপর্যায়ে রাত ৩টার দিকে পুলিশের সহায়তায় ট্রাক নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে যায় অপরাধীরা। ঘটনার দিন বিশেষ কারণে ক্যাম্পাসে ছিলেন না তৎকালীন প্রভোস্ট ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. ইকবাল কবির জাহিদ।

এ ঘটনার একদিন পর ৭ অক্টোবর এস এম শামীম হাসান (জিইবিটি), বিপ্লব কুমার দে (জিইবিটি), তানভীর ফয়সাল (ইএসটি), মো. আল মামুন শিমন (পিইএসএস), মো. মাসুদুর রহমান রনি (পিইএসএস), আশিক খন্দকার (পিইএসএস), তানভীর আহমেদ তানিন (পিএমই), আশিক খন্দকারসহ (পিএমই) বহিরাগত আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একইদিনে রিজেন্ট বোর্ডের (৪৪তম) জরুরি সভার মাধ্যমে এ সাত শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে এ ডাকাতির ঘটনা অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন শামীম।

আরো পড়ুন: কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারীদের ৮১ শতাংশের বেতন ১০ হাজার টাকার নিচে

২০১৭ সালে হলটির ৩২৪ নম্বর রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী থাকা মোহাম্মাদ ফিরোজ বলেন, গভীর রাতে আমি ও আমার রুমমেট হিমু হঠাৎ ককটেলসহ বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পাই। এরপর হলে শোরগোল শুরু হলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে নিচতলায় ১২২ নম্বর রুমে আশ্রয় নিই। গুলি ও বোমার আওয়াজে ভয়ে আমরা বেডের নিচে শুয়ে পড়ি। পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা বাইরে এসে শুনতে পাই আক্রমণকারী বিভিন্ন রুম থেকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। তারা নিজেদের রুমে গিয়ে দেখেন লকার ভেঙে দু’টি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ থেকে  টাকা নিয়ে গেছে। পরবর্তীতে আবেদন করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি।

রিজেন্ট বোর্ডের (৪৪তম) জরুরি সভার মাধ্যমে এ সাত শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে এ ডাকাতির ঘটনা অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন শামীম।

চতুর্থ তলার ভুক্তভোগী আরেকজন আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ঘটনার রাতে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালিয়েছিল তৃতীয় ও পঞ্চম তলায়। এক জুনিয়রকে তারা মারধর করে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও টাকা নিয়ে গিয়েছিল। বাঁচার জন্য অনেকে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েছে। অনেকে হল থেকে পালিয়ে শিক্ষক ডরমেটরিতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা প্রক্টরের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে সহযোগিতা চাইলেও তারা আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। পরবর্তীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছিনতাই করা জিনিসের ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেও আমরা পাইনি। ডাইনিংইয়ে এক মাসের ফ্রি খাবার বরাদ্দ থাকলেও সে টাকাও পরে ছাত্রলীগ সভাপতি সুব্রত ভাগ করে নিয়েছে। 

ঘটনায় ভুক্তভোগী ও আহত এফএমবি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সন্ত্রাসীরা আমাকে লোহার পাইপ দিয়ে অমানবিকভাবে পেটাতে থাকে। এতে আমার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। আর্থিক সাহায্যের জন্য আমি আবেদন করলেও প্রথমে ক্ষতিপূরণ পাইনি। পরে আমার মা প্রক্টর ও প্রভোস্ট অফিসে একাধিকবার কথা বলে আবেদন করলে কিছু সাহায্য করা হয়।

এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম শামিম হাসান বলেন, ঘটনার ১০-১২ দিন আগে উপাচার্য আনোয়ার স্যারের সঙ্গে ক্যাম্পাসে আসার বিষয়ে কথা হয়। তার সম্মতিতেই আমরা ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ঘটনার দিন আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমরা হলে ঢুকি। এরপর গভীর রাতে ঝামেলা শুরু হলে আনোয়ার স্যার আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি তোমাদের চলে যেতে বলেছি। তোমরা চলে যাও। 

তিনি বলেন, আমি ক্যাম্পাসে এসে প্রয়োজনে এসপি, ডিসি সবাইকে নিয়ে বসে তোমাদেরকে ক্যাম্পাসে আনব। এরপর প্রক্টর ও প্রভোস্ট বডি এসে আমাদের সাথে কথা বলে পুলিশি পাহারায় নিরাপদে শহরে পৌঁছে দেয়। মোবাইল-ল্যাপটপ ছিনতাইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সবাই ছাত্র ছিল, কেউ টোকাই ছিল না। মোবাইল-ল্যাপটপ ও টাকা-পয়সা নেওয়ার বিষয়ে কেউ কোথাও কোনও অভিযোগ করেন নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এ নিয়ে মিথ্যা মামলায় আমি ও আমার সহযোদ্ধাদের নাম জড়িয়ে চক্রান্ত করা হয়েছে।

আরো পড়ুন: ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত ভর্তি সম্পন্ন হবে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে

তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক শেখ মিজানুর রহমান বলেন, রাত ১১টার দিকে আমি বিষয়টি জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দু’জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অন্যদের দেখতে পাই। জানতে পারি, ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ অপর গ্রুপকে হল থেকে বের করে দখল করেছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য পুলিশ নিয়ে হলে প্রবেশ করতে চাইলে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন নিষেধ করেন। তারপরও পেশাগত দায়িত্ব পালনে জীবনের ঝুকি নিয়ে পুলিশ ছাড়া হলে প্রবেশ করেছিলাম। 

হলে প্রবেশ করেই শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এস এম শামিম হাসানকে দেখতে পেয়ে চলে যেতে বলেন জানিয়ে প্রক্টর বলেন, শামিম ঘণ্টা দুয়েক সময় নিয়ে হল থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছিল তারা। পুলিশের উপস্থিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সম্মতিতে এ কাজটি করা হয়। তবে জানতে পারি, তারা চলে যাওয়ার সময় বেশ কিছু ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিস নিয়ে চলে যায়।

প্রক্টরের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, হল ডাকাতির সময় আমি বগুড়ায় ছিলাম। তখন আমার সঙ্গে যশোরের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রব্বানী যোগাযোগ করেন এবং তাদের বাহিনী নিয়ে হলে প্রবেশের অনুমতি চান। কিন্তু আমি পুলিশকে একা হলে ঢোকার অনুমতি দিইনি। এরপর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টরকে পুলিশ নিয়ে হলে প্রবেশ করতে বলি। কিন্তু প্রক্টর পুলিশকে কোনো সাহায্য করেনি এবং ঘটনাস্থলেও যাননি।

এ বিষয়ে শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের তৎকালীন সহকারী প্রভোস্ট ড. মো. মজনুজ্জামান বলেন, রাত ১১টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে আমি জানতে পারি হলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম ও তার অনুসারীরা ডাকাতি করছে। শিক্ষার্থীদের মারধর করে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হল থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে জানান, তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। পরবর্তীতে পুলিশ, আনসার ও সহকারী হল প্রভোস্টদের নিয়ে গিয়ে দেখি, প্রক্টর ভেতর থেকে ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন। এরপর হল থেকে বেরিয়ে দেখি, মসজিদের পাশ থেকে কিছু কালো মাইক্রোবাস পুলিশের সহায়তায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করছে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence