শিক্ষক সংকটে ব্যাহত হাবিপ্রবির শিক্ষা কার্যক্রম

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়   © ফাইল ফটো

বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩ অনুযায়ী হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) মোট শিক্ষক ৩৮৩ জন। এর মধ্যে শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন ৭৮ জন। ফলশ্রুতিতে প্রয়োজনের তুলনায় কম শিক্ষকের কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে গতি আসছেনা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিগ্রি অর্জনের পর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিলেও নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে উদাসীন কতিপয় শিক্ষক। তাদের অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানে সময় ব্যয় করতে বেশি আগ্রহী। 

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ালিটি ক্লাসের ব্যাপারে কতিপয় শিক্ষকের গুরুত্ব কম। দায়সারাভাবে ক্লাস নেন তারা। সোস্যাল সাইন্স এন্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদের কোন শিক্ষক ৮-১০ কিংবা তারও বেশি কোর্স নিয়ে থাকেন। সেসব ক্লাসের মান ও পড়ানোর ধরণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে।

এর পেছনে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন ও অতিমাত্রায় শিক্ষক রাজনীতির পেছনে সময় ব্যয়কে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও শিক্ষক সংকট এই সমস্যার পেছনে অন্যতম প্রভাবক বলে মত অনেক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহলের। ফলে নাজেহাল অবস্থায় ঢিমেতালে চলছে বিভাগগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষক সংকটের কারণে পিছিয়ে পড়ছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সবগুলো বিভাগেই তৈরি হচ্ছে সেশনজট। নির্ধারিত সময়েরও মাস খানেক পর শুরু হচ্ছে সেমিস্টার। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এভাবে চলতে থাকলে আরও পিছিয়ে পড়বেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন। ২০২৪ সেশনের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। সেখানে হাবিপ্রবিতে বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত রয়েছে ১:৩৬। অর্থাৎ প্রতি ছত্রিশ জন শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র একজন শিক্ষক আছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চশিক্ষার ছুটিতে শিক্ষকের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। কিন্তু সমস্যা হয় যখন ভারসাম্য রক্ষা না করে ছুটি মঞ্জুর করা হয়। একটি বিভাগ যদি পাঁচ জন শিক্ষকের মধ্যে তিনজনকেই ছুটি দেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী  একটি বিভাগে ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে যেতে পারবেন। এই নীতিমালা অনুযায়ী হাবিপ্রবির ফিশারিজ টেকনোলজি  বিভাগে ৬ জন শিক্ষকের সর্বোচ্চ ২ জন শিক্ষক, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে ১০ জন শিক্ষকের ২-৩ জন শিক্ষক,  ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৫ জন শিক্ষকের ১ জন,  সিএসই বিভাগের ২০ জন শিক্ষকের ৪-৫ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে যেতে পারবেন। কিন্তু ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগে ৬ জনের  মধ্যে  ৪ জন,  ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ১০ জনের ৬ জন ,  ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৫ জনের মধ্যে ২ জন এবং সিএসই বিভাগে ২০ জনের মধ্যে ১০ জনই শিক্ষা ছুটিতে গেছেন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শোচনীয়  অবস্থায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ টি অনুষদ। সেখানে শিক্ষার্থী অনুপাতে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। এর মধ্যে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে ২৬ জন শিক্ষকের মধ্যে ১১ জন শিক্ষা ছুটিতে, সিএসই অনুষদে ৪১ জনের মধ্যে ১৫ জন, বিজ্ঞান অনুষদে ৩৪ জনের মধ্যে ৯ জন, সোস্যাল সায়েন্স এন্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদে ৩০ জনের মধ্যে ৭ জন, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ৩৭ জনের মধ্যে ১১ জন শিক্ষা ছুটিতে।

ফিশারিজ অনুষদের অধীনে ৪ টি বিভাগ রয়েছে। যেখানে ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট এর ৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩ জন, ফিশারিজ টেকনোলজিতে ৬ জনের মধ্যে ৪ জন এবং একোয়াকালচার এ ৮ জনের মধ্যে ৩ জন শিক্ষা ছুটিতে। বর্তমানে ৫ টি লেভেল এ ৪৬৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ৪৬৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১৫ জন শিক্ষক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১.৩১। অর্থাৎ ৩১ জন শিক্ষার্থীর জন্য গড়ে ১ জন শিক্ষক আছেন সেখানে।

বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অধীনে ৪ টি বিভাগ রয়েছে। যেখানে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ৯ জনের মধ্যে ২ জন, মার্কেটিং বিভাগে ৯ জনের মধ্যে ৩ জন এবং ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে ১০ জনের মধ্যে মধ্যে ৬ জন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। এই অনুষদে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি বিভাগে ৫০ জন করে মোট ২০০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানো হচ্ছে। বর্তমানে ৪টি ব্যাচ চলমান রয়েছে। ৪ টি বিভাগ মিলে প্রায় ৯২৫ জন শিক্ষার্থী এই অনুষদে পড়াশুনা করছেন। সেখানে ৩৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জন শিক্ষা ছুটিতে। ৯২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ২৫ জন শিক্ষক।শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১.৩৭। 

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৪ টি বিভাগের ইংরেজি বিভাগে ৮ জনের মধ্যে ২ জন, অর্থনীতি বিভাগে ১০ জন শিক্ষকের মধ্যে ৪ জন,  ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৫ জনের মধ্যে ২ জন শিক্ষা ছুটিতে। বিজ্ঞান অনুষদের রসায়ন বিভাগে বর্তমানে বিএসসি অনার্স ও এমএস এর ২ টি ব্যাচের সর্বমোট প্রায় ৪৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত। রসায়ন বিভাগে মোট শিক্ষক রয়েছেন ৯ জন, এর মধ্যে শিক্ষা ছুটিতে ৩ জন। ৪৫০ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য রয়েছেন ৬ জন শিক্ষক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১.৭৫।  ৭৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক। 

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বর্তমানে বিএসসি অনার্স ও এমএস এর ২টি ব্যাচের সর্বমোট প্রায় ৪০০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে মোট শিক্ষক রয়েছেন ৯ জন, এর মধ্যে শিক্ষা ছুটিতে ৩ জন। ৪০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য রয়েছেন ৬ জন শিক্ষক। শিক্ষক- শিক্ষার্থীর অনুপাত ১.৬৬। অর্থাৎ ৬৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক আছেন সেখানে।

ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ৬০ জন শিক্ষকের মধ্যে ১০ জন শিক্ষা ছুটিতে। এর মধ্যে ফুড সায়েন্স এন্ড নিউট্রশন বিভাগে ৭ জনের মধ্যে ৩ জন, এগ্রিকালচার এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ১১ জনের মধ্যে ৩ জন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৯ জনের মধ্যে ৩ জন শিক্ষা ছুটিতে। সিএসই অনুষদের ৩ টি বিভাগের সিএসই বিভাগে ২০ জন শিক্ষকের মধ্যে ১০ জন এবং ইসিই বিভাগে ১১ জনের মধ্যে ৪ জন শিক্ষা ছুটিতে। 

ফিশারিজ অনুষদের শিক্ষার্থী কল্লোল কুমার মোদক বলেন, টেকনিক্যাল সাবজেক্ট হিসাবে আমাদের অনুষদে (ফিশারিজ) শিক্ষকদের চাহিদার অনুপাতে কর্মরত শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক কম। একুয়াকালচার আর ফিশারিজ টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে চরম পর্যায়ের শিক্ষক সংকটের কারণে রেগুলার ক্লাস ও পরীক্ষাতে সমস্যা লেগেই থাকে। তবে এক্ষেত্রে কর্মরত শিক্ষকদের প্রসংসা না করলেই নয়। তাদের অতিরিক্ত চাপ নেয়া আর চেষ্টার কারণেই অনার্স লেভেলে একসাথে ৫ টা ব্যাচের ক্লাস, পরীক্ষা, ভাইভা সব মোটামুটি সঠিক সময়েই চলছে। শিক্ষক নিয়োগই একমাত্র এই সমস্যা নিরসন করতে পারে বলে মনে করি।

ফিশারিজ অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. এ. এস. এম. কিবরিয়া বলেন,  "হায়ার স্টাডিজ দরকার আছে। তাই এটি বন্ধ রেখে এ সমস্যা সমাধান করা যাবে না। সমস্যা সমাধানের উপায় হতে পারে পার্ট টাইম টিচার নিয়োগ। পাশাপাশি টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও অনার্সের সেরা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর জন্য সেন্ট্রালি বা বিভাগীয় প্রধানের নেতৃত্বে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। আমাদের নিয়োগ হচ্ছে না নিয়মিত। নিয়মিত নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক সংকট নিরসন হলে সেশনজট কমে আসবে।"

আরও পড়ুন: ১১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট পেল হাবিপ্রবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষনা ইনস্টিটিউট এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম বলেন, শিক্ষা ছুটি সাধারণত ৩-৪ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষক চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে খন্ডকালীন শিক্ষক অথবা গেষ্ট টিচার নিয়োগ দিতে হবে।

ইউজিসির সদস্য সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী একটি বিভাগের সর্বোচ্চ ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে যেতে পারবেন। যদি কোন বিভাগে ৫ জন শিক্ষক থাকে তবে একজন  শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে যেতে পারবেন।  ইউজিসির শিক্ষা ছুটির নীতিমালা অনুসরণ করা  হলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হবে না।


সর্বশেষ সংবাদ